বিবর্ণ স্বাধীনতা
রাণা চ্যাটার্জী
স্বাধীনতা (১)
"স্বপ্ন দেখায় স্বাধীনতা"
চায়ের দোকানে সকালে রবীন, ঝাঁপি খুলতেই,ওপারে রেললাইন থেকে ঝুপড়ির হই চই শব্দ,গান উল্লসিত প্রমোদ ভেসে আসা শুনতে পায়।রোজ দেখে চেনা কালু,পটলা,ইসলাম,জোসেফরা সকাল হলেই কাগজ কুড়োনোর ফাঁকা বস্তা পিঠে সফর শুরু করে নিত্যনৈমিত্তিক পচানে কালযাত্রা। নোংরা আবর্জনা ঘেঁটে,পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বোতল, ফেলে দেওয়া এটা সেটা কুড়িয়ে তারপর আয়েশ করে চা,টোস্ট ,ঘুগনি,খেতে আসে পরম শান্তিতে রবীনের দোকানেই।
কোনো দিন দোকান ফাঁকা পেলে,সমবয়সী এদের সাথে ,ওদের দু দন্ড জিরোনোর সময়, ভাব বিনিময় হাসি,মস্করা করার সুযোগ হয়ে যেত।সকাল সন্ধ্যা, জল ঘেঁটে কাপ,প্লেট ধোওয়া স্যাঁতসেঁতে হাতে, মা মরা,বারো বছরের রবীন।
সংযোজন:
ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা,,, তোমাতেই আমার বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা,,,,
মালিক না থাকলে কাজ চালিয়ে নেবার মালিক হয়ে উঠতো।খুশি হয়ে, কখনো কেমন বিস্কুট বা চা'য়ের দাম কম করে এদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করবে কি ,হার না মানা নাছোড়বান্দা,লড়াই করা এরা কিছুতেই সে রাস্তায় হাঁটবে না।
"গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!"
জোর করে টাকা মিটিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে এই সেনাপতির দল।এগুলো ভীষণ ভাবে স্পর্শ করে রবীন কে।সেও উপলব্ধি করে,কিছু না থাকা মানুষগুলোর অভিমান একটু বেশি হয়,যেমন তার মা মারা যাবার পর সংসারটা ভেসে গেলেও কাকার পরিবারে হাত পেতে কেবল কি করে খাবে,এটা মেনে নিতে কষ্ট হবে বলে জোর করে চায়ের দোকানে কাজে ঢুকেছে আত্মসম্মান রক্ষা করার তাগিদে,,,,
সংযোজন:
সর কাট যায়েগে তো আচ্ছা,,,,মগর জিল্লত কি জিন্দেগী গবারা নাহি,,,,
হম ধরতি পর যাহা ভি রাহে মগর এ মা মরনে কে বাদ তেরা তিরাঙ্গা কাফন মে চাহিয়ে,,,,
বল বীর বলো মম চির উন্নত শির,,,,,
হাড় লিক লিকে ,পাকানো,শীর্ণ শরীরের দশ বারো বছর বয়সী ওদের মুখে পয়সা বাঁচানোর কথা,বাড়ির বাজার খরচা,কেউ নিজেদের মধ্যে মায়ের ওষুধ কেনার কথা বললে,নিঃশব্দে রবিনের মনটা বিহ্বল ও চোখের কোণ ভিজতো।
দেখতে দেখতে আজ ,আর একটা, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের শুরু,কানে ভাসছে কুচকাওয়াজ।প্যারেড মাঠে কদিন থেকে মহড়া শুরু হয়েছে ...।
সংযোজন:
নানহা নানহা রাহী হুঁ,,, দেশ কা সিপাহী হুঁ
বলো মেরে সঙ্গ,,, জয়হিন্দ,,, জয়হিন্দ,,,,
টিউশন করে আসার পথে আমিও দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, পতাকা উত্তোলন,কুচকাওয়াজ,
বন্দে মাতরম ধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ ।স্বাধীন ভারতের এই যে সম্মান প্রদর্শন করার চিরাচরিত পদ্ধতি দেখে মন,ভরে যাবার মুহূর্তেই ভিড়ের মাঝে পিঠে প্লাস্টিক,ছেঁড়া কাগজ বোঝার বস্তা নেওয়া মুখ গুলো দেখে ত্রি রঞ্জিত গর্বের পতাকা কেমন জানি একটু বিবর্ণ রংচটা লাগছিল,হয়তো ওদের ফ্যাকাশে মুখের প্রতিফলন। ভাবুক মন যেন তখনো কল্পনায় দেখছিলো ওদের এন.সি.সির খাকি পোষাকে প্যারেড মাঠে,জয়হিন্দ ভঙ্গিমায়।
" সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুসিতা হামারা,,,,
হাম বুলবুলে হে ইসকি,,, এয়ে গুলসিতা হামারা,,,, হামারা",,,,,,
বেলা গড়িয়ে গেছে অথচ ওরা আসছে না টিফিন করতে! এঁটো কাপ ,প্লেট ধুতে ধুতে রবীনও বেশ উসখুস করছে ।হাতের কাজ সামলে একটু আসছি বলে মালিকের অনুমতি নিয়ে বেলার দিকে ওপাড়ার দিকে পা বাড়াতেই দেখে প্যারেড মাঠ থেকে ফিরে ও গুলো কি সুন্দর ভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করার চেষ্টায় রত হয়েছে।আর কেউ কাজে বের হয় নি,ছিটেবেড়া ,ভাঙা চোরা দেয়ালে কেউ নেতাজী,কেউ ক্ষুদিরাম কেউ ভগৎ সিংয়ের ছবি,কাগজের পতাকা গুলোকে, কি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রেখেছে।
"কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।"
হেঁটে যাওয়া পথচলতি সকলকে হাসিমুখে লজেন্স
দিয়ে জোড়হাত করে বার্তা দিচ্ছে ওরা "কাকুরা যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না "
রবীন ও একটা চকলেট মুখে,গর্বিত শ্বাস নিয়ে,
পতাকা হাতে পা বাড়ালো চা দোকানের দিকে।
ততক্ষণে জমে যাওয়া আরও এক গামলা এঁটো বাসন,রবীনের কচি দুটো হাতের অপেক্ষায়...।
"ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্কা টানে!
মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!"
মালিকের রেডিও তে ভেসে এলো,কোন এক জনদরদী নেতার উন্নত ভারত গড়ার স্বপ্ন বার্তা,এক গুচ্ছ ফিরিস্তি।!জয় হিন্দ।শুভ হোক প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বিবর্ন ,রংচটা স্বাধীনতার প্রতিবিম্বে।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি,,,,
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন