শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-৫ / রূপক সামন্ত

[নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে। বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।
পরমাত্মা স্বরূপ যাঁরা নিত্যকাল নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলদেব, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেবকে প্রণতি নিবেদন করি।]

আজ থেকে প্রায় ঊনচল্লিশ বছর আগে বাবার হাত ধরে, তারকেশ্বর থেকে বড় একটা দলের সাথে, প্রথমবার পুরী গেছিলাম। সেবার জগন্নাথ মন্দিরের উল্টোদিকে একটি ধর্মশালায় সাতদিন ছিলাম। বাবা, প্রয়াত ডঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত ছিলেন পন্ডিত গবেষক মানুষ। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটি সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তারপর ঠিক করে নিতেন কোন কোন বিষয়গুলি গভীর মনোনিবেশ সহকারে দেখবেন। তাঁর ঝোলায় খাতা ও কলম থাকত। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি তাতে লিখে নিতেন। তারপর ফিরে এসে সে সম্পর্কে আরও পড়াশোনা করতেন ও লিখতেন। পুরীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। এর আগেও একবার ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে তিনি পুরীতে মাসখানেক ছিলেন। ফলে পুরী তাঁর কাছে তখনই অনেকটা চেনা জায়গা। সেবারে বাবাকে ভোর তিনটের সময় উঠে, স্নানাদি সেরে, জগন্নাথদেবের বিশেষ অঙ্গসজ্জা দেখার জন্য মন্দিরে যেতে দেখেছি। পুরীর জগন্নাথ মন্দির সম্পর্কে তিনি দুটি অনবদ্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রথমটি--'পুরীর মন্দিরের দেওয়াল চিত্রণ', ১৯৮০-৮১ পাঠবৎসরের 'বাঁকুড়া খৃশ্চান কলেজ পত্রিকা'য় প্রকাশিত। দ্বিতীয়টি--'পুরীর মন্দিরের মূর্তকলা', ১৪০৫ সালের 'খেয়ালী' পত্রিকায় প্রকাশিত। পরবর্তীকালে প্রবন্ধদুটি তাঁর 'সংস্কৃতি ও শিল্পভাবনা' বইতে গ্রন্থিত হয়েছে [ প্রকাশক-সাহিত্য প্রকাশ, ৬০ জেমস লঙ সরণি, কলকাতা-৩৪, প্রথম প্রকাশ-৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪, পরিবেশক-পুস্তক বিপণি, ২৭ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা-৯]। পুরী ও জগন্নাথ সম্পর্কে অজস্র গ্রন্থ, প্রবন্ধাদি লেখা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমি কিন্তু স্বল্প পড়াশোনায় জগন্নাথ মন্দিরের ও সংলগ্ন অন্যান্য মন্দিরের দেওয়াল চিত্রণ নিয়ে কোনও আলোচনা কোথাও দেখিনি বা শুনিনি। প্রথম প্রবন্ধটি এবিষয়ে একেবারেই নতুন একটি দিকনির্দেশ। প্রসঙ্গতঃ জানাই যে এই দেওয়াল চিত্রগুলি এঁকেছেন পুরী থেকে ১২ কিমি দূরে, ভার্গবী নদীর ধারে অবস্থিত রঘুরাজপুর শিল্পগ্রামের শিল্পীরা। তাঁরাই প্রতিবছর রঙের প্রলেপ দিয়ে এই চিত্রগুলিকে উজ্জীবিত করেন। আমার জগন্নাথ সম্পর্কিত নিবেদনে এই প্রবন্ধদুটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। প্রভু জগন্নাথ সম্পর্কিত নিবেদনের মাঝে সেকারণে এই আত্মকথনটুকুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাঁর শ্রীচরণে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

পৌরাণিক এবং লোককাহিনীতে আমরা জেনেছি যে মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রথম জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর পরিচয় সম্পর্কে দু'টি মত প্রচলিত আছে। একটি মতে ৪৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পণ্ডুবংশের রাজা ছিলেন উদয়ন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইন্দ্রবল ই পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে কীর্তিত হন। আরেকটি মতানুসারে সূর্যবংশের রাজা রামচন্দ্রের দুই পুত্র কুশ ও লব এর মধ্যে কুশ এর বংশের ঊনিশতম উত্তরপুরুষ হলেন দেবলিক। এই দেবলিকের পুত্রই হলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। তখন কিন্তু নীলমাধবের পুজো হত। ইন্দ্রদ্যুম্নই জগন্নাথদেবের পুজো প্রচলন করেন। একটি কাহিনীসূত্র জানাচ্ছে যে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নে জগন্নাথদেবের সম্পূর্ণ রূপটি দর্শন করেছিলেন। রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্নও এই শ্রীক্ষেত্র দর্শন করেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।



উড়িষ্যার মন্দিরস্থাপত্যরীতি অনুসারে জগন্নাথদেবের আধুনিক মন্দিরটি নির্মিত। এই দেবদেউল চারটি স্তরে বিন্যস্ত।  সবচেয়ে উঁচু পীঢ়াদেউলটি হল বিমান বা গর্ভগৃহ। এরমধ্যেই রত্নবেদীতে স্থাপিত আছেন বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথ ত্রয়ী দেবতাসহ মোট সাতটি বিগ্রহ। দেউলের পরবর্তী অংশটি হল জগমোহন, তার পরের স্তরটি নাটমন্ডপ এবং শেষ স্তরটির নাম ভোগমন্ডপ। নাটমন্ডপের দেওয়ালে, স্তম্ভগুলিতে, ছাদের সিলিংয়ে সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের অজস্র পৌরাণিক চিত্র অঙ্কিত আছে।


ডঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্তের প্রবন্ধে সেগুলি সম্পর্কে  আলোচনা আছে। এগুলির মধ্যে সিলিংএ, ত্রিকোণাকৃতি ক্ষেত্রে অঙ্কিত দুটি বিশেষ জগন্নাথ চিত্রের কথা বিশদে লিখেছেন তিনি। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী 'গরুড়স্তম্ভের মাথার উপর অংশে বাঁকানো সিলিংএ ছবিটি আঁকা হয়েছে। ছবিটি পশ্চিমমুখী।  অর্থাৎ মন্দির অভ্যন্তরে বেদীর ওপর রক্ষিত দারুব্রহ্মের দিকে মুখ করে আছে। বেদীর ওপর রক্ষিত দারুমূর্তি ত্রয়ের মধ্যে প্রধান বলরাম ও জগন্নাথ, সুভদ্রার মূর্তি তুলনামূলকভাবে ছোট। বলরাম ও জগন্নাথের দারুমূর্তি দ্বিবাহু সমন্বিত এবং উচ্চতায় অবয়বে প্রায় সমান। দারু জগন্নাথ স্থূল নাসা ও স্ফীতোদর। কিন্তু সিলিংয়ের ত্রিভুজ এ ছবিটিতে জগন্নাথের প্রাধান্য। জগন্নাথ এখানে চতুর্ভুজ। উপবিষ্ট মূর্তি। তাঁর কোলে সুভদ্রা ও তাঁর মাথার পিছনে বলরাম। উভয়েই বসে আছেন। আঁকা ছবির জগন্নাথের নীলাঞ্জন গাত্রবর্ণ  চোখ জুড়িয়ে দেয়। তাঁর মুখাবয়ব, তাঁর চতুর্ভুজ সংস্থান, তাঁর উপবেশন ভঙ্গি নিখুঁত সুন্দর। এই মূর্তিচিত্রণ ঘটেছিল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্বপ্নে দেখা জগন্নাথের মূর্তি অনুযায়ী। ঐ ত্রিভুজ চিত্রের তিনটি ভুজই প্রায় ৫ ফুট দীর্ঘ। এই চিত্রটির মুখোমুখি বিপরীত দিকের ঢালু সিলিংয়ে আর একটি স্বপ্নদৃষ্ট জগন্নাথের চিত্রমূর্তি অঙ্কিত হয়েছে। এটিও ৫ ফুট বাহুর একটি পটচিত্রণ। চিত্রটি পুবমুখী। চিত্রটিতে সামান্য হলেও ভীষণতার বিভাব বর্তমান। এখানে জগন্নাথের মুখ নৃসিংহ অবতারের সিংহমুখের মতো। এখানেও জগন্নাথ চতুর্ভুজ এবং উপবিষ্ট, কোলে উপবিষ্ট সুভদ্রা। জগন্নাথের মাথার পিছনে বলরাম। বলরামের মাথায় সর্পছত্রফণা।' নাটমন্দিরের দেওয়ালচিত্রগুলি দেখতে দেখতে তাঁর সঠিক উপলব্ধি-'সহজেই বোঝা যায়, যেভাবেই হোক, বলরাম-সুভদ্রা-জগন্নাথের চিত্র অঙ্কনের জন্যই শ্রেষ্ঠতম শিল্পী-প্রতিভা নিয়োগ করা হয়েছিল। বর্ণবিন্যাস, অলঙ্করণ, অবয়ব সংস্থান প্রভৃতির দিকে নজর দিলে অনুভব করা যায় চিত্রশিল্পীর ভক্তি ও ভালোবাসা, সাধনা ও সিদ্ধির নিবিড়তা।'

শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-৪ / রূপক সামন্ত

['যে করে আমার আশ
আমি করি তার সর্বনাশ
তবুও যে করে আমার আশ
আমি হই তার দাসানুদাস' ---প্রচলিত কীর্তন]

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বৈশাখ মাসের শুক্লা নবমী তিথির মাহেন্দ্রক্ষণে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। যথাসময়ে মন্দিরের কাজ শেষ হল। সমস্যা হল অন্য। জগন্নাথদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও উপযুক্ত ব্রাহ্মণের সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন দেবর্ষি নারদের আদেশে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মাকে এই মন্দির-প্রতিষ্ঠা মহাযজ্ঞের হোতা ব্রাহ্মণ পদে বরণ করার আবেদন নিয়ে স্বর্গে গেলেন। সেখানে ব্রহ্মাকে সব নিবেদন জানানোর পর তিনি রাজাকে অপেক্ষা করতে বললেন। ইতিমধ্যে বহু বৎসর কেটে গেছে। সমুদ্রের ধারে নির্মিত মন্দিরটি বালির তলায় চাপা পড়ে গেল। সে মন্দিরের খবর সবাই বিস্মৃত হল। উড়িষ্যার রাজা তখন সুরদেবপুত্র গলমাধব। একদিন সমুদ্রের তীর ধরে যাওয়ার সময় তিনি দেখলেন যে একটি ঘোড়া বালির উঁচু ঢিপিতে আটকে পড়েছে। কিছুতেই বার হয়ে আসতে পারছে না। রাজা গলমাধব গেলেন ঘোড়াটিকে উদ্ধার করতে। তিনি বুঝতে পারলেন যে ঘোড়ার পা বালির নীচে কোনও কিছুতে আটকা পড়েছে। রাজার নির্দেশে লোকজন সেই ঢিপির বালি সরিয়ে আবিষ্কার করল বালিচাপা সুন্দর এক মন্দির। রাজা সেই মন্দিরের শৈলী ও কারুকাজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কে তৈরি করল এত সুন্দর মন্দিরটি!!! কেনই বা মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়ে বালিচাপা পড়ে গেল!! এসব প্রশ্নের কোনও সমাধান হল না। লোকমুখে মন্দিরটি গলমাধবের মন্দির বলে প্রচলিত হল।

ইতিমধ্যে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে মর্ত্যে ফিরলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। সব দেখেশুনে তিনি গলমাধবের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে মন্দিরটি ফেরৎ চাইলেন। গলমাধব বললেন যে তিনি কোনও ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার নাম শোনেন নি। এই মন্দির তিনি নির্মাণ করিয়েছেন। কাজেই ফেরৎ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মার কাছে বিহিত চাইলেন। তখন ব্রহ্মা ধ্যানযোগে সবকিছু জেনে বিধান দিলেন-- “মন্দিরটি বালির মধ্যে থেকে বার করার জন্য গলমাধবের প্রাপ্য আছে। তবে মিথ্যা বলার জন্য ওর নাম সবাই ভুলে যাবে। কেউ মনে রাখবে না গলমাধবের কথা।” তাইই হল। রাজা গলমাধবের কথা লোকের মন থেকে হারিয়ে গেল। পুনরায় রাজা হলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন।

দুই রাণীর গর্ভে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আঠারোটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। এছাড়াও ত্রিলোকিনী নামক বড়রাণীর এক সহচরীর গর্ভে তনুদ্ভব নামক আর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করল। প্রধান রাণীদের আঠারো জন পুত্রই ছিল উচ্ছৃঙ্খল, দুর্বিনীত, অতিভোজী, অতিনিদ্রালু, মদমত্ত ও নারীবিলাসী। তারা জগন্নাথদেবের পূজা করত না। প্রত্যেকেই রাজা হওয়ার জন্য উদগ্রীব। তনুদ্ভব কিন্তু ছিল ধর্মপরায়ণ ও বিনীত। জগন্নাথদেবের প্রতি তার অচলা ভক্তি। একারণে রাজা তনুদ্ভবকে বিশেষ স্নেহ করতেন। একদিন রাজা সকল পুত্রদের নিয়ে জগন্নাথদেবের মন্দিরে গেলেন। মন্দিরের সিংহদ্বারের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় রাজা নীচে পড়ে গেলেন। তনুদ্ভব ছাড়া আর কোনও পুত্র রাজার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো না। তখনই রাজা তনুদ্ভবকে পরবর্তী রাজা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আঠার পুত্র রাজার এই সংকল্পের কথা শুনে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধঘোষণা করল। তখন পিতার আশীর্বাদে তনুদ্ভব ওই আঠারো জন রাজপুত্রকে পরাজিত করে ক্ষতবিক্ষত করে আহত করল। এইবার আহত মরণাপন্ন রাজপুত্রগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে জগন্নাথপদে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগল। জগন্নাথদেব তাদের শ্রীক্ষেত্রের নিকট আঠারোটি নালার রূপ ধরে অবস্থান করতে বললেন। সাধুগণ যখন ওই আঠারো নালা পেরিয়ে শ্রীক্ষেত্রে যাবেন তখন তাঁদের পদরেণুস্পর্শে ধীরে ধীরে তাদের পাপক্ষয় হবে। এই দৈববাণী শোনার পর আঠারো জন রাজপুত্র প্রাণত্যাগ করলেন।


জগন্নাথদেব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে দৈববাণীতে জানালেন-- তোমার দাসীপুত্র তনুদ্ভবকে রাজা করো। চল্লিশ বছর রাজত্ব করার পর তার মৃত্যু হবে। তখন তুমি নরেন্দ্রপুত্র গাল'এর হাতে রাজ্যভার দিয়ে ব্রহ্মলোকে গমণ করবে। এখন তুমি পুত্রদের সৎকারের ব্যবস্থা কর। শ্রীক্ষেত্রের বাইরে সারি সারি আঠারোটি নালা কেটে তাদের উপর আঠারোটি চন্দনকাঠের চিতা প্রস্তুত করবে। সেইসব চিতার উপর তোমার আঠারো জন সন্তানকে শুইয়ে দাহকার্য করবে। এই আঠারোটি নালার উপর দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা করবে। সেই পথের উপর সাধুজনের পদরজ পড়লে তোমার পুত্রদের সদগতি হবে। তুমি নিজে পরম বৈষ্ণব। তোমরা পুত্ররা বৈষ্ণব-আত্মজ। সেইহেতু যারা তোমার পুত্রদের চিতাভস্ম স্পর্শ করবে তারা মহাপাপী হলেও তাদের সকল পাপ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। তারা অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করবে।

এই নির্দেশ অনুযায়ী রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আঠারোটি নালা কেটে তার উপর পুত্রদের সৎকার করলেন। আজও জগন্নাথমন্দিরের উত্তরদিকে এই আঠারো টি নালা অতি পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়। আজও সাধুসন্তরা এই আঠারো নালার উপর দিয়েই জগন্নাথমন্দিরে আসেন।


তনুদ্ভব রাজা হওয়ার পর দুই রাজরাণীই গত হলেন। তখন রাজা তপস্যায় মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলে মার্কন্ডেয়মুনি রাজাকে বললেন- তোমার কোথাও তপস্যা করতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার কোনও যাগযজ্ঞ বা তপস্যার প্রয়োজন নেই। এই নীলাচল হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ। তুমি এখানেই প্রভু জগন্নাথের সেবা করে যাও।--রাজা নীলাচলেই প্রভুর সেবা ও ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে রইলেন।


অনেক বছর এমনইভাবে কেটে গেলো। একদিন জগন্নাথদেব রাজাকে দেখা দিয়ে বললেন-- তোমার কাজ পূর্ণ হয়েছে। ভগবান ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে গমণের জন্য রথ পাঠাচ্ছেন। সেখান থেকে বৈকুণ্ঠে এসে আমার সান্নিধ্য লাভ করে মোক্ষপ্রাপ্ত হবে। আজ থেকে তোমার কোনও বংশই থাকবে না। আজ মধ্যাহ্নে তনুদ্ভবকে আমার কাছে প্রেরণ করবে আর নরেন্দ্রপুত্র গলমাধবকে রাজ্যের ভার অর্পণ করবে।

রাজা নির্দেশমত তনুদ্ভবকে মন্দিরে পাঠালেন। তনুদ্ভব মন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথকে দর্শন করতেই তার গোটা শরীরটা গরুড়স্তম্ভে লীন হয়ে গেল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের নির্বংশ হওয়ার প্রার্থনা পূরণ হল। এই ঘটনার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গলমাধবের হাতে রাজ্যভার দিয়ে জগন্নাথসেবার সমস্ত বিষয় সবিস্তারে বুঝিয়ে দিলেন।  তারপরই দেখতে পেলেন ব্রহ্মাপ্রেরিত পুষ্পরথ শূন্যে অপেক্ষা করছে। রাজা বুঝতে পারলেন যে তাঁর দেহ রাখার সময় হয়েছে। তিনি কালক্ষেপ না করে শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথের মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে প্রাণবায়ু শরীর ত্যাগ করে গেল। তাঁর পবিত্র আত্মাকে পুষ্পরথে চাপিয়ে নিয়ে দেবসারথী ব্রহ্মলোকে গমণ করলেন। রাজা গলমাধব বহু বৈষ্ণব সমাহারে, নামসংকীর্তন সহযোগে, ইন্দ্রদ্যুম্নের মরদেহ পঞ্চতীর্থের জলে স্নান করিয়ে বিধিমত অগ্নিসৎকার করলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূতঃদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেও পৌরাণিক কাহিনীতে অমর হয়ে রয়ে গেলো তাঁর কীর্তি।



পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত

জয় জগন্নাথ-২ / রূপক সামন্ত

পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণ তীরবিদ্ধ করল যে জরা ব্যাধ, কে সে? কী তার পরিচয়!! ঘটনাটি ঘটেছিল পশ্চিমভারতের প্রভাস তীর্থে। তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স একশ সাত বছর। ক্ষমা করো প্রভু, আমার কূ'মন বলছে কোনও ব্যাধই তীর চালনা করেনি শ্রীকৃষ্ণকে লক্ষ্য করে। শ্রীকৃষ্ণ জরাগ্রস্ত হয়ে কালের স্বাভাবিক নিয়মেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একই কারণে সমবয়সী অর্জুনও গাণ্ডীব উত্তোলনের ক্ষমতা হারিয়েছেন। যদুবংশের রমণীদের দস্যুরা লাঞ্ছনা করছে এদৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরকে। এটাই আসল বাস্তবসম্মত কারণ। দেহপট সনে নট সকলি হারায়--আর শ্রীকৃষ্ণ তো স্বয়ং নটশ্রেষ্ঠ রসিক নটবরচন্দ্র। পুরাণ কিন্তু বলছে অন্য কথা। দ্বাপরের মহাভারতের সময়ে এই ঘটনা যে ঘটবে তার বীজ বপন হয়েছে আগের ত্রেতাযুগে। সেইযুগে বিষ্ণুর অবতার হলেন নবদূর্বাদলশ্যাম শ্রীরামচন্দ্র আর লক্ষ্মীদেবী সীতারূপে জন্মগ্রহণ করেছেন।


বনবাসকালে সীতাকে অপহরণ করেছেন লঙ্কারাজ রাবণ। সীতা উদ্ধারের জন্য সহায়সম্বলহীন রামচন্দ্র বন্ধুত্বের হাত মিলিয়েছেন আত্মগোপনকারী বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে। বন্ধুত্বের শর্ত পালন করতে গিয়ে রামচন্দ্র অন্যায়ভাবে সুগ্রীবঅগ্রজ বানররাজ মহাবলী বালীকে বধ করলেন। রামের কাছে বালীর কোনও অপরাধ ছিল না। তবুও সুগ্রীবের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় বালীকে পিছন থেকে লুকিয়ে হত্যা করলেন অবতার রামচন্দ্র। এ কেমন লীলাখেলা!! তোমার মহিমা তুমিই জানো প্রভু!! আমি হীনবুদ্ধি, সাধ্য কী সে মহিমা হৃদয়ঙ্গম করি! তা বালী বধের পর নিষ্কণ্টক রাজা হলেন সুগ্রীব। আর যুবরাজ হলেন বালীপুত্র মহাশক্তিধর অঙ্গদ। নাহ, অঙ্গদ কোথাও বালীহত্যা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেন নি। তাঁর মা রূপসীশ্রেষ্ঠা বিদূষী তারা যে নিজ পিতৃব্যের অঙ্কশায়িনী হলেন তা নিয়েও কোনও বক্তব্য অঙ্গদের মুখে রাখেন নি মহাকবি বাল্মিকী ও অন্যান্য রামায়নকারগণ। অঙ্গদের তৎকালীন মনের অবস্থার কোনও সংবাদ রামায়নে নেই। উপরন্তু লঙ্কাযুদ্ধে  রামচন্দ্রের অতিবিশ্বস্ত সেনাপতি হলেন অঙ্গদ। যুদ্ধশেষে সীতা উদ্ধারের পর রামচন্দ্র অঙ্গদকে বর চাইতে বললেন। জানেন কী বর চেয়েছিলেন অঙ্গদ সেদিন!! পিতৃহত্যার পুঞ্জিত রাগ, ক্ষোভ, বেদনা আর বাধা মানলো না।  বর চাইলেন- প্রভু, আমি যেন আমার পিতৃঘাতককে শাস্তি দিতে পারি। সাবাশ অঙ্গদ!! আর কোন বর চাইবার থাকতে পারে পিতৃহত্যাকারীর কাছে!!
রামচন্দ্র মৃদু হেসে বলেছিলেন-তথাস্তু। তোমার আশা পূর্ণ অবশ্যই হবে অঙ্গদ, ভক্ত আমার। -- দ্বাপরে শ্রীরামচন্দ্র হলেন শ্রীকৃষ্ণ, আর অঙ্গদ জরা ব্যাধ পরিচয়ে জন্ম নিলেন। শ্রীকৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিলেন তিনি।

জরা ব্যাধ সম্পর্কিত একটি অন্য কাহিনীও আছে। সেটি নিবেদন করি। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের নশ্বর মরদেহ পঞ্চপাণ্ডব পশ্চিমভারতের প্রভাসতীর্থে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন। এই প্রভাসতীর্থ আরবসাগরের তীরে অবস্থিত। আবরসাগরের জলে ভাসতে ভাসতে পুরুষোত্তমের দেহ এলো দক্ষিণভারতের ভারত মহাসাগরে। তারপর বঙ্গোপসাগরের জলে ভেসে ভেসে কতদিনে এসে উপস্থিত হল কলিঙ্গদেশে। ততদিনে নীলকান্তমণিসদৃশ গোপীবল্লভ কৃষ্ণতনু অত্যুজ্জ্বল এক নীল পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই দেবপ্রস্তরটি এসে উপস্থিত হল আজকের শ্রীক্ষেত্র পুরীতে। পাথর জলে ভেসে এল কীকরে!!! হয় হয়, তাঁর মহিমায় সবই হয়। বিশ্বাসে জলে ভাসে শিলা। ত্রেতায় যদি রামেশ্বরমে সমুদ্রজলে শিলা ভাসিয়ে সেতুবন্ধ তৈরি করা যায়, তবে দ্বাপরেই বা হবে না কেন! তখন ওইস্থানে সমুদ্রের ধারে গহীন বনে শবর জনজাতির বাস ছিল। শবররাজ জরা এই নীল পাথরটিকে সমুদ্রজলে ভাসন্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন। সযত্নে তুলে এনে গোপনে স্থাপন করলেন রোহিণীকুণ্ডের তীরে। তৎকালীন ঘন জঙ্গলাকীর্ণ রোহিণীকুণ্ডের অবস্থান বর্তমানের জগন্নাথ মন্দিরের পিছনদিকে। এককালের বিশাল সরোবর আজ ছোট একটি চৌবাচ্চায় পরিণত হয়েছে। তবু আজও এর জল অতি পবিত্র মানা হয়। শবররাজ জরা অতি গোপনে প্রত্যহ যথোবিধ ভক্তিসহকারে এই নীল পাথরটির পূজা করতে লাগলেন। ইনিই হলেন 'নীলমাধব'।

তখন কলিঙ্গের রাজা ছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি ঈশ্বরদর্শনের মানসে অতি কঠিন তপস্যা শুরু করলেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁকে স্বপ্নাদেশে পরমেশ্বর নীলমাধবের কথা জানালেন। অনেক সন্ধান করেও রাজা কিন্তু নীলমাধবের অবস্থান জানতে পারলেন না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে বিদ্যাপতি নামক এক তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্রাহ্মণকে রাজা এই দায়িত্ব দিলেন। বিদ্যাপতি ছলে-কৌশলে রোহিণীকুণ্ডের তীরে নীলমাধবের অবস্থান জেনে রাজাকে সংবাদ দিলেন। রাজা সদলবলে রেহিণীকুণ্ডে এসে নীলমাধব দর্শনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর চিত্তে নীলমাধবকে দেউলে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করার সাধ জাগলো। সসম্মানে ভক্তিভরে নীলমাধবকে নিয়ে ফিরে চললেন তিনি। তখন কি শবররাজ জরা কোনও বাধা দেন নি! তাঁর যে প্রাণপ্রিয় আরাধ্য দেবতা ওই নীলমাধব। হয়ত দিয়েছিলেন, হয়ত প্রবল রাজশক্তির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি!! আমি মূর্খজন, জানিনা জানিনা সেসব কথা।


রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কিন্তু নীলমাধবকে নিয়ে রাজধানীতে যেতে পারলেন না। পথিমধ্যে নীলমাধব সহসা অন্তর্ধান করলেন। ভগ্নহৃদয় রাজার কান্নায় পরমেশ্বরের হৃদয় বিগলিত হল। দৈববাণী হল-- রাজা, তুমি অতি প্রত্যুষে সমুদ্রস্নান সেরে শুদ্ধচিত্তে তটে অপেক্ষা করবে। দেববিগ্রহ নির্মাণের উপকরণ আসবে তোমার কাছে। -- সেই নির্দেশমত পরদিন রাজা সমুদ্রস্নান সেরে সমুদ্র
তটে প্রতীক্ষায় রইলেন। সমুদ্রের জলে ভেসে এল শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম চিহ্নশোভিত দারুখণ্ড। মহানন্দে রাজা পূজাপাঠ করে সেই দেব-দারুকে রাজপুরীতে নিয়ে এলেন। সমস্যা দেখা দিল অন্য। কে তৈরি করবে দেববিগ্রহ!! কোনও তক্ষণশিল্পীর অস্ত্রাঘাতে সেই দারুখণ্ডে বিন্দুমাত্র দাগ পড়ল না। এখন উপায়!! মাথায় হাত দিয়ে বসলেন রাজা। স্নানাহার বন্ধ হল তাঁর। অগত্যা শরণাগতি। একাগ্র প্রার্থনা-- হে প্রভু, তুমিই এর উপায় করে দাও। তখন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা বৃদ্ধ তক্ষণশিল্পী 'অনন্ত মহারাণা' নাম নিয়ে এলেন রাজদরবারে। শর্ত দিলেন বদ্ধঘরে একুশদিনে তিনটি মূর্তি তৈরি করবেন তিনি। ওইসময় কোনওমতেই ঘরের দরজা খোলা চলবে না। শিল্পীকেও ডাকা চলবে না। দেবমূর্তি তিনটির রূপ তিনি ওইসময়েই তপস্যায় জেনে নেবেন। নিরুপায় রাজা মেনে নিলেন সব শর্ত। অনন্ত মহারাণা ওই দেব-দারুর যথাবিহিত পূজান্তে কর্মশালার ঘরের বেদীতে স্থাপন করে তাঁর যন্ত্রপাতিসমেত ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। রাজাদেশে বাইরে থেকে ঘরের দরজায় পড়ল তালা, আর তালার উপর সীলমোহর। রক্ষী নিযুক্ত হল দ্বারে। রাজ্যশুদ্ধু লোক বাইরে রইলেন শবরীর প্রতীক্ষায়।

একদিন গেল, দুদিন গেল--- সকলের উদগ্রীব প্রতীক্ষা সন্দেহে পরিণত হল। আদৌ বন্ধঘরে কিছু হচ্ছে তো!! কোনও শব্দ তো ভেসে আসছে না বাইরে! ভিতরে যে কেউ আছে, কোনও মূর্তি যে তৈরি হচ্ছে তার কোনও লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। এদিকে মূর্তিপ্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে। আয়োজনও প্রায় সমাপ্ত। সবাই উদ্বিগ্ন, রাজা নিজেও বিভ্রান্ত। তথাপি শর্ত লঙ্ঘন করলেন না তিনি। পনেরদিনের মাথায় বেঁকে বসলেন পাটরাণী গুণ্ডিচা। রাজাকে বললেন - মহারাজ, মনে হচ্ছে ওই শিল্পী আপনাকে প্রতারণা করেছে। আপনি দ্বার উন্মুক্ত করুন। রাজা রাজী হলেন না। তখন মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করলেন মহারাণী। বললেন-বেশ, আমিও তাহলে আমার ঘরে খিল দিচ্ছি। আজ রাত্রির মধ্যে আপনি যদি কর্মশালার দ্বার উন্মুক্ত না করেন, তবে আগামীকাল প্রত্যুষে আমি আত্মহত্যা করব। এই বলে সত্যিসত্যিই মহারাণী তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করে আগল দিলেন। মহারাজা পড়লেন বিষম ফাঁপরে। শর্ত রাখি, নাকি রাণীকে রাখি!! যুগে যুগে রমণীর অভিমানের কাছে পুরুষ বড় অসহায়। বাধ্য হয়ে মহারাজ কর্মশালার দ্বার উন্মুক্ত করার আদেশ দিলেন। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলেন কেউ নেই সেখানে। বৃদ্ধ শিল্পী অন্তর্হিত হয়েছেন। পড়ে আছে অসম্পূর্ণ হস্তপদবিশিষ্ট অসমাপ্ত তিন বিগ্রহ। দুটি দেববিগ্রহ-- জগন্নাথ আর বলভদ্র। একটি দেবীবিগ্রহ-সুভদ্রা। কী আর করেন রাজা!! মনের দুঃখে অসমাপ্ত বিগ্রহত্রয়ীকেই প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিলেন।


পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-৩ / রূপক সামন্ত


প্রভু জগন্নাথকে কেন্দ্র করে যে সুপ্রাচীন সংস্কৃতির ধারা আজও সবেগে বহমান, তার প্রাণবিন্দু হলেন নীলমাধব। নীলমাধব সম্পর্কিত প্রচলিত কাহিনীগুলির মধ্যে ঘটনাপরম্পরার সাযুজ্য থাকলেও কাহিনী, স্থান ও পাত্রের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন আর একটি কাহিনীতে বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণের মৃতদেহ সমুদ্রজলে ভাসতে ভাসতে ইন্দ্রনীলা পাথরে, মতান্তরে নীলাভ দারুখণ্ডে পরিণত হয়েছিল। এই ইন্দ্রনীলা পাথর এসে পৌঁছুলো উড়িষ্যারাজ্যের মহানদীর তীরে। বর্তমানে নয়াগড় জেলার খণ্ডপাড়া ব্লকের কান্তিলো নামক জায়গায়। জায়গাটি ভুবনেশ্বর থেকে ৭৩ কিমি দূরে অবস্থিত। এটি উড়িষ্যার মহানদী, কুসমী ও কুঁড়িয়া (kaunria) নদীর ত্রিবেণীসঙ্গম। দুটি পাহাড়ের মাঝে জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে তখন শবর জনজাতির বাস ছিল। শবররাজ বিশ্বাবসু এই ইন্দ্রনীলাকে নিয়ে এসে এক গুহায় অত্যন্ত গোপনে স্থাপন করে নিত্যপুজো করতেন। এখনও এখানে অতিপ্রাচীন নীলমাধবের মন্দির আছে। মন্দিরটির আকৃতি জগন্নাথ মন্দিরের ন্যায়। নীলমাধবের পাদপদ্ম থেকে নির্গত হয়েছে অবিরাম পুণ্য জলধারা। আর আছেন সিদ্ধেশ্বরনাথ। এখানে রথ সপ্তমীর উৎসব খুবই বিখ্যাত। মাঘ মাসের একাদশী তিথিতে এখানে মেলা বসে। পৌষপূর্ণিমায় হয় বিশেষ উৎসব। সেদিন নীলমাধব স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত হয়ে ভক্তদের দর্শন দেন।

সেইসময় মালবদেশের রাজা ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন মালবদেশের রাজা। অবন্তীনগরে তাঁর রাজধানী। একদিন এক সন্ন্যাসী এসে রাজাকে পুরুষোত্তমপুরের নীলপর্বতে নীলমাধবের মাহাত্ম্য জানালেন। বললেন- নীলমাধব মুক্তিপ্রদায়ক। তাঁর পূজায় মোক্ষলাভ হয়।--রাজার হৃদয়ে নীলমাধব দর্শনের ইচ্ছা প্রবলতর হল। তিনি রাজপুরোহিতের ভ্রাতা বিদ্যাপতির উপর নীলমাধবের সন্ধানের দায়িত্ব দিলেন। বিদ্যাপতি নানাভাবে অণ্বেষণ করে শবররাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ রাখালরাজ নন্দদুলালের রূপ ধরে বিদ্যাপতিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। শবররাজ বিশ্বাবসু সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদ্যাপতিকে গৃহে স্থান দিলেন। অতিথিসেবার ভার অর্পিত হল সদ্যযৌবনা রাজকন্যা ললিতার উপর। বিদ্যাপতি ছিলেন বিবাহিত। তথাপি বিদ্যাপতি ও ললিতা পরস্পরের প্রেমে পড়লেন। ফলস্বরূপ ললিতা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন। তিনি  বিদ্যাপতিকে বিবাহ করার জন্য অনুরোধ করলেন।


বিদ্যাপতি রাজী হলেন একটি শর্তে--নীলমাধবের দর্শনলাভ। শুনে চমকে উঠলেন ললিতা। তা কী করে সম্ভব!! এই কথা যে অত্যন্ত গোপনীয়। পিতা বিশ্বাবসু আর ললিতা ছাড়া আর কারও তা জানার কথা নয়। এই বিদেশী কিভাবে জানলেন এই অতিগূহ্য কথা!! খুবই চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন ললিতা। গর্ভস্থ সন্তানের পরিচয়ের প্রশ্নে অবশেষে মাতৃত্ব জয়ী হল। বিদ্যাপতির চোখ বেঁধে নানা ঘুরপথে নিয়ে গেলেন নীলমাধব দর্শনে। বুদ্ধিমান বিদ্যাপতি ললিতার অলক্ষ্যে সারা পথে সরিষাদানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। নীলমাধব দর্শনে মোহিত হলেন বিদ্যাপতি। মনে বাসনা হল যে নীলমাধবকে রাজধানীতে নিয়ে যাবেন। কিছুদিন পর বিদ্যাপতি-ললিতার এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। তখন বিদ্যাপতি রাজধানীতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। নীলমাধবকে নিয়ে যাওয়ার বাসনায় সরিষাগাছের চিহ্ন ধরে নীলপর্বতের গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন। এদিকে অন্তর্যামী নীলমাধব বিদ্যাপতির মনোভাব জেনে অন্তর্ধান করলেন। অন্যমতে বিশ্বাবসুই ললিতার নিকট সব জেনে নীলমাধব দর্শনে নিয়ে যান। তিনিই বিদ্যাপতির মনোভাব বুঝতে পেরে নীলমাধবকে গোপন করেন। যাইহোক বিদ্যাপতি ফিরে এসে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে সবকিছু নিবেদন করলেন। রাজা সৈন্যসামন্ত নিয়ে নীলমাধবকে আনার জন্য নীলপর্বতে উপস্থিত হলেন। নীলমাধব অন্তর্হিত হয়েছেন শুনে রাজা নিতান্ত ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন। অনশনে প্রাণত্যাগ করার জন্য কুশশয্যায় শয়ন করলেন। তখন দেবর্ষি নারদ দৈববাণীতে বললেন- হে রাজন। তোমার প্রাণত্যাগের প্রয়োজন নেই। এইস্থানে জগন্নাথদেব তোমার মাধ্যমে দারুব্রহ্মরূপে পূজা পাবেন। স্বয়ং পিতা ব্রহ্মা একথা বলেছেন।---একথায় উজ্জীবিত হয়ে রাজা অন্নগ্রহণ করলেন।

এরপর একরাতে শ্রীবিষ্ণু স্বপ্নাদেশে জানালেন-- তুমি আমার প্রিয় ভক্ত। আমি ভক্তের কাছ থেকে কদাপি দূর হই না। আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্মরূপে পাবে।।

দৈবনির্দেশ অনুযায়ী রাজা স্নানাদি তর্পণ সেরে শুদ্ধচিত্তে সমুদ্রতটে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। জায়গাটি হল বর্তমানের চক্রতীর্থ, শ্রীক্ষেত্র পরিক্রমার অতি পুণ্যস্থান।  যথাসময়ে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চিহ্নশোভিত বিশাল একখন্ড কাঠ ভেসে এল সেখানে। রাজা পরমানন্দিত হলেন। ভক্তগণ নামকীর্তন করতে লাগলেন। রাজা ওই কাঠটিকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার উদ্যোগ করলেন। কাঠটিকে কিন্তু একচুলও নড়ানো সম্ভব হল না। এমনকি অনেকগুলি হাতি দিয়ে টেনেও নড়ানো সম্ভব হল না। রাজা হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। তখন দৈববাণী হল-- শবররাজ বিশ্বাবসু আমার পরম ভক্ত। তাকে পরম সমাদরে আনার ব্যবস্থা করো। আর একটি স্বর্ণরথ আনয়ন কর। -- রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, রাজা বিশ্বাবসু ও বিদ্যাপতির সহায়তায় সেই কাঠটিকে সোনার রথে চাপিয়ে নামসঙ্কীর্তন করতে করতে রাজধানীতে নিয়ে এলেন। পাটরাণী গুন্ডিচার আবাসস্থল গুন্ডিচাবাটিতে শাস্ত্রসম্মত কর্মশালার মহাবেদী নির্মিত হল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল। এবার মূর্তি তৈরির পালা। এরপরের কাহিনী সবই আগের মত।

বিশ্বকর্মা, মতান্তরে স্বয়ং জগন্নাথদেব অনন্ত মহারাণার রূপ ধরে এসে শর্তসাপেক্ষে বদ্ধ কর্মশালায় একুশদিনে মূর্তি তৈরিতে রাজী হলেন। তিনি রাজাকে আরও বললেন- যে সমস্ত তক্ষণশিল্পী মূর্তি তৈরি করতে এসে বিফল হয়েছেন, তাঁদের দিয়ে তিনটি অত্যুত্তম রথ প্রস্তুত করান। --সেইমত ব্যবস্থা হল। অনন্ত মহারাণা কর্মশালায় প্রবেশের পর দ্বার বন্ধ করে প্রহরী নিয়োগ করা হল।

মহারাণী গুণ্ডিচা কিন্তু কৌতুহল দমন করতে পারলেন না। শ্রীবিষ্ণুর দারুরূপ দর্শনের মানসে চৌদ্দদিনে, মতান্তরে নয়দিনে, কর্মশালার দ্বার উন্মুক্ত করে দেখলেন -- তিনটি অসম্পূর্ণ বিগ্রহ। আর শিল্পী অন্তর্হিত হয়েছেন। --- একী মূর্তি শ্রীবিষ্ণুর!!! দেহের ঘন কৃষ্ণ বর্ণ, গোলাকার চক্ষুদ্বয়, হস্তপদহীন---এই অপ-রূপ দর্শনে রাণী মূর্চ্ছা গেলেন। সংবাদ পেয়ে রাজা এসে রাণীকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলেন। এখন তবে উপায়!! অসম্পূর্ণ বিগ্রহ কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে!! কোনও শাস্ত্র এ অনুমোদন দেবে না। --দুশ্চিন্তায় ভগ্নমনোরথ রাজার দুচোখ জলে ভেসে গেল। তখন ভগবান বিষ্ণু আবার স্বপ্ন দিলেন রাজাকে। বললেন --- “আমার ইচ্ছায় দেবশিল্পী মূর্তি নির্মাণ করতে এসেছিলেন। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ হওয়াতে এই রূপ মূর্তি গঠিত হয়েছে। হে রাজন, তুমি আমার পরম ভক্ত, আমি এই অসম্পূর্ণ মূর্তিতেই তোমার পূজা নেবো। আমি দারুব্রহ্মরূপে পুরুষোত্তমক্ষেত্রে নিত্য অবস্থান করবো। আমি প্রাকৃত হস্তপদ রহিত, কিন্তু অপ্রাকৃত হস্তপদাদির দ্বারা ভক্তের সেবাপূজা শ্রদ্ধা গ্রহণ করবো। আমি ত্রিভুবনে সর্বত্র বিচরণ করি। লীলা মাধুর্য প্রকাশের জন্য আমি এখানে এইরূপে অধিষ্ঠান করবো। শোনো নরেশ -- ভক্তেরা আমার এই রূপেই মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণ রূপের দর্শন পাবেন। যদি তুমি ইচ্ছা করো তবে ঐশ্বর্য দ্বারা সোনা রূপার হস্ত পদাদি নির্মিত করে আমার সেবা করতে পারো। ” সেই নির্দেশ অনুসারে উল্টোরথের পর একাদশীর দিন তিন বিগ্রহের সুবর্ণ-বেশ রথের উপর স্থাপন করা হয়। সেই বেশ দেখলে সাত জন্মের পাপ ক্ষয় হয়  বলে ভক্তজনের বিশ্বাস।


স্বপ্নেই রাজা জগন্নাথদেবের কাছে প্রার্থনা জানালেন যেন শিল্পী অনন্ত মহারাণার বংশধরগণ যুগ যুগ ধরে জগন্নাথের রথ নির্মাণের অধিকারী হয়। জগন্নাথদেব বললেন-তথাস্তু। তিনি রাজাকে আরও নির্দেশ দিলেন- শবররাজ বিশ্বাবসুর বংশধরগণ সেবক হবে। সেইথেকে আজও রথযাত্রার সময় শবররাই তিনবিগ্রহের বেশভূষা শৃঙ্গারাদি সেবা সমাপন করেন। জগন্নাথদেবের ইচ্ছায় বিদ্যাপতির প্রথমা স্ত্রী'র গর্ভস্থ সন্তানের বংশধরগণ হলেন জগন্নাথের পূজারী। আর ললিতা হলেন বিদ্যাপতির দয়িতা স্ত্রী অর্থাৎ প্রণয়িনী। তাঁর গর্ভের সন্তানের বংশধরগণ জগন্নাথের ভোগ প্রস্তুতের দায়িত্ব পেলেন। এঁরা দয়িতাপতি বা দৈতাপতি উপাধি লাভ করলেন।

যে বছর আষাঢ় মাসে বত্রিশ দিন হয়, সেই বছর জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা, সুদর্শন ও নীলমাধবের নবকলেবর উৎসব হয়। নবকলেবরের সময় এই দৈতাপতিরাই বিষ্ণুচিহ্নযুক্ত উপযুক্ত বৃক্ষের সন্ধান করেন। পূজাদি সমাপনান্তে সেই বৃক্ষগুলিকে ছেদন করে নিয়ে আসেন বৈকুণ্ঠ কোইলির কর্মশালায়। তারপর নবকলেবর প্রস্তুত হলে একান্ত গোপনে পুরোনো কলেবর থেকে নবকলেবরে জগন্নাথের ব্রহ্মস্থাপন করেন। পুরোনো কলেবরগুলিকে সমাধিস্থ করারও দায়িত্ব দৈতাপতিদের। দেখা গেছে যে নবকলেবরে ব্রহ্মস্থাপনের পর দৈতাপতি আর বেশিদিন বাঁচেন না। তাই এখন সবচেয়ে প্রাচীন দৈতাপতিই এই সেবা পালন করেন।

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জগন্নাথদেব স্বপ্নাদেশে তাঁর নিত্যপূজার আচারবিধি নির্দেশ করলেন। রাণী গুন্ডিচা এই অপরূপ বিষ্ণুকে সন্তানরূপে সেবার মানস করলেন। জগন্নাথদেব সে ইচ্ছাও পূরণ করলেন। সেই বর অনুযায়ী রথযাত্রার দিন থেকে মোট নয়দিন জগন্নাথদেব, বলভদ্র,সুভদ্রা ও সুদর্শন-গুন্ডিচার বাড়িতে সন্তানস্নেহে পালিত হন। গুণ্ডিচাবাটি হল জগন্নাথের মাসির বাড়ি।

সব নির্দেশ দেওয়ার পর জগন্নাথদেব ভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্নকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন- রাজন এবার তুমি বর চাও।-- রাজা পরমভক্ত। আর পরমভক্ত হবেন নিষ্কাম। রাজা এমনই ভক্ত যে তাঁর ইচ্ছায় জগন্নাথ এই অপরূপ মুরতি ধারণ করেন। তিনিও বড় কম নন। রাজা বিচিত্র এক বর চাইলেন। এমন বর আর কখনও কেউ চায় নি। রাজা প্রার্থনা করলেন--- প্রভু, আমাকে তুমি নির্বংশ করো। যাতে আমার কোনও বংশধর তোমার মন্দির ও তার সম্পত্তিতে অধিকার না ফলাতে পারে।---ধন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। নিষ্কাম সেবার প্রকৃত অধিকারী আপনিই। জগন্নাথদেব সেই বরও পূরণ করেছিলেন। অন্যসময় বলা যাবে সে কাহিনী। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথদেবকে কথা দিলেন-- সারাদিনে মাত্র একপ্রহর বা তিনঘন্টার জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকবে। বাকি সময় তা ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সারাদিন সবসময় আপনার সেবা ও ভোজন চলবে এখানে।--- মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। পুরোহিত হলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন তিনিই।


পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-১/ রূপক সামন্ত

বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় তীর্থক্ষেত্র ও পর্যটনস্থান হল উৎকল রাজ্যের পুরী। স্থানটির অনেক নাম। যতদূর দৃষ্টিসীমানা, ততদূর নীল অঞ্জন ঘন সমুদ্র - তাই এর নাম নীলাচল। পুরীর জগন্নাথ আদিতে ছিলেন নীলমাধব- সেকারণেই নীলাচল। জায়গাটির আকৃতি শঙ্খের ন্যায় এবং অজস্র সমুদ্র শঙ্খ পাওয়া যেত এখানে- তাই এটি শঙ্খক্ষেত্র। জগন্নাথ মন্দিরের স্থানটির কচ্ছপের পিঠের মত গড়ন- তাই এটি কূর্মক্ষেত্র। এছাড়া সবাইকার প্রিয় নাম হল পুরী। এছাড়াও পুরীর অন্য নামগুলি হল- পুরুষোত্তমধাম, উড্ডীয়ানপীঠ, মর্ত্যবৈকুণ্ঠ, উচ্ছিষ্টক্ষেত্র ইত্যাদি।

আচার্য শঙ্কর ভারতের চারদিকে চারটি প্রধান মঠ স্থাপন করলেন। বদরিকাশ্রম, দ্বারকাশ্রম, নীলাচলাশ্রম ও রামেশ্বরাশ্রম। পুরাণ মতে প্রভু জগন্নাথ উত্তরভারতের বদ্রীধামে স্নানাদি সেরে, পশ্চিমভারতের দ্বারকায় বেশভূষা ও প্রসাধন করে, পূর্বভারতের নীলাচলে অন্নগ্রহণ করে, দক্ষিণভারতের রামেশ্বরমে শয়ন করেন। পুরী নীলাচলে জগন্নাথ অন্নগ্রহণ করেন বলে এর অপর নাম অন্নক্ষেত্র। পুরীতে কেউ কখনও না খেয়ে থাকে না।

প্রভু জগন্নাথ জগতের নাথ। সবাই তাঁর সেবক। সবচেয়ে বড় সেবক হলেন স্বয়ং পুরীর রাজা। তিনি কেমন রাজা জানেন!! তিনি ঝাড়ুদার রাজা। জগন্নাথের রথযাত্রার সময় তিনি রথের পথ সোনার ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে যান। এমনটি আর কোথাও যে নেই।

জরা ব্যাধের বিষতির শ্রীকৃষ্ণের রাঙা চরণে এসে বিঁধলো। জরা হরিণ ভেবে তীর নিক্ষেপ করেছিল। ভুল বুঝতে পেরে লুটিয়ে পড়ল ওই রাঙা পায়ে-- প্রভু ক্ষমা করো। আমি মূর্খ ব্যাধ, না জেনে, ভুল করে তীর নিক্ষেপ করেছি। আমার এই অমার্জনীয় অপরাধ ক্ষমা করো প্রভু। ক্ষমা করেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী মহাভারতের প্রধান হোতা ও চালিকাশক্তি সারথী শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর কাজ শেষ হয়েছে। এবার তো যেতে হবে। মৃত্যুবরণ করলেন তিনি। দাদা বলরাম আগেই গেছেন।  সমগ্র যদুকূল আগেই নিঃশেষ হয়েছে। সব তিনি অসহায়ভাবে দেখেছেন। রোধ করতে পারেন নি। এটাই কী পরবর্তী অবতার ঠুঁটো জগন্নাথের আসার সঙ্কেত!! জানি না প্রভু। তোমার লীলা তুমিই জানো কেবল। আমি দীনজন দু'হাত তুলে বলি - জয় জগন্নাথ।

শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুসংবাদ গিয়ে পৌঁছলো হস্তিনাপুরের রাজা যুধিষ্ঠিরের দরবারে। রাজা যুধিষ্ঠির!! কেমন রাজা তিনি!! সর্বহারা রাজা, সব সবাইকে হারিয়েছেন কুরুক্ষেত্রের পুণ্য রণাঙ্গনে। শক্তিহীন রাজা তিনি। কেন বলছি জানেন! পাণ্ডবঅক্ষের প্রধান শক্তি অর্জুন তখন আর গাণ্ডীব তুলতে পারেন না। তিনি আর অজিত গান্ডীবী নন। সেই রাজা যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে ছুটে এলেন শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। ব্যথাভরা হৃদয়ে সৎকার্যের আয়োজন করলেন। সমুদ্রতীরে রচিত হল সুগন্ধী চন্দনকাঠের শয্যা। পারলৌকিক শাস্ত্রাচার মেনে শ্রীকৃষ্ণের, প্রিয় সুহৃদ ও প্রিয় ভ্রাতার ঘৃতচর্চিত নশ্বর দেহ শোয়ানো হল সেই শয্যায়। সুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের সাথে মুখাগ্নি করলেন যুধিষ্ঠির। হায় প্রভু!! নিজ বংশের কোনও মানুষের হাতে তোমার মুখাগ্নি জুটলো না। এ কেমন লীলা প্রভু তোমার!  বুঝেছি  রাজা হয়েও, গোপীজনের মনোহরা হয়েও, মহাভারতের সারথী হয়েও কেন তুমি সর্বহারা। বুঝেছি কেন বলেছিলে- কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন।নাহ, বাজেনি সেদিন পাঞ্চজন্য! কে বাজাবে!  তিনিই তো নেই আর। আছে শুধু ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ-- পাঞ্চজন্য নির্ঘোষ--সাধারণ পঞ্চজন-- পঞ্চায়েতি রাজ।

অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। পুড়ে ছাই শতমণ চন্দনকাঠ। কিমাশ্চর্যম!! তবুও সেই কৃষ্ণদেহ পুড়লো না একটুকুও। পুড়লো না একখানি কেশ তাঁর। বিস্ময় বিস্ময়। বিস্ময়ে হতবাক পঞ্চপাণ্ডব। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাহলে এখন উপায়!! তখন অকস্মাৎ দৈববাণী-- এই পরমপুরুষের দেহ কেন তোমরা দাহ করবার চেষ্টা করছো! স্বয়ং অগ্নিদেব তো তাঁরই আজ্ঞাধীন। তাঁর ক্ষমতা ও স্পর্ধা নেই এই দেহকে দাহ করার। তোমরা বরং রত্নালয় সমুদ্রজলে ভাসিয়ে দাও এই দেহ। রত্ন মিশে যাক রত্নালয়ে। অগত্যা তাই করলেন পঞ্চপাণ্ডব। চোখের জলে ভাসিয়ে দিলেন প্রিয় দেহটি সাগরের লবণজলে। তারপর!!! প্রবজ্যায় বেরোলেন পাঁচভাই। বহু দেশ ও তীর্থ ভ্রমণ করে এলেন নীলাচলে। জগন্নাথক্ষেত্রে শাস্ত্রসম্মত শ্রাদ্ধ করলেন শ্রীকৃষ্ণের। জায়গাটির নাম বৈকুণ্ঠ কোইলি। জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে একটি বাগান। জগন্নাথ - সুভদ্রা- বলরাম ত্রয়ীর নব কলেবর হওয়ার পর, পুরাতন কলেবর এখানেই সমাধিস্থ করা হয়।

অভিজিৎ দাস কর্মকার,,,রথযাত্রা ও আজকের সমাজ


রথযাত্রা সংখ্যায় বিশেষ আকর্ষণ,,,,,

রথযাত্রা ও আজকের সমাজ,,,,,


অভিজিৎ দাসকর্মকার


বেদে জগন্নাথের সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। তিনি দশাবতার অথবা বৈদিক হিন্দু দেবমণ্ডলীর সদস্যও নন। অবশ্য কোন কোন ওড়িয়া গ্রন্থে জগন্নাথকে বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে বুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। বিষ্ণুর রূপভেদ হিসেবে জগন্নাথ এক অসাম্প্রদায়িক দেবতা। তাঁকে এককভাবে হিন্দুধর্মের কোন একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না। বৈষ্ণব , শৈব , শাক্ত, স্মার্ত সকল শাখার অনুগামীরাই জগন্নাথকে পূজা করেন। এমনকি বৌদ্ধ  ও জৈন ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গেও জগন্নাথের যোগ দেখানো হয়।

জগন্নাথের সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবটি হল বাৎসরিক রথযাত্রা। এই উৎসবের সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মূল মন্দিরের (বড় দেউল) গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরী তিনটি বিরাট রথে (প্রতি বছরই নতুন করে প্রতিটি রথ তৈরি হয়- জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ- রথে জগন্নাথের সঙ্গী হন মদনমোহন- নন্দীঘোষের উচ্চতা ৪৫ ফুট, ১৬ চাকা- ৮৩২ কাঠের টুকরো দিয়ে গড়া হয় রথ- লাল ও হলুদ কাপড়ে সাজানো হয়- নন্দীঘোষের সারথির নাম দারুকা- রথের মাথায় থাকা পতাকার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী- এই রথে ৪ ঘোড়া থাকে- জগন্নাথের রথের রশির নাম ‘শঙ্খচূড়া নাগুনি’- জগন্নাথের রথে সওয়ার হন আরও ৯ দেবতা- এঁদের মধ্যে আছেন গোবর্ধন, কৃষ্ণ, নরসিংহ, রাম, নারায়ণ, হনুমান, রুদ্র- জগন্নাথের রথে একজন রক্ষীও থাকেন- এই রক্ষীর নাম গারুদা

- বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ- রথে বলভদ্রের সঙ্গী হন রামকৃষ্ণ- তালধ্বজের উচ্চতা ৪৪ ফুট- এই রথে মোট ১৪ চাকা রয়েছে- ৭৬৩ কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় রথ- লাল ও সবুজ কাপড়ে সাজানো হয় রথ- তালধ্বজের সারথির নাম মাতালি- তালধ্বজের রক্ষীর নাম বাসুদেব- রথের মাথায় পতাকার নাম উন্যানী- রথের রশির নাম বাসুকি নাগ- বলভদ্রের রথেও ৯ দেবতা থাকেন- এঁদের মধ্যে আছেন কার্তিক, গণেশ, সর্বমঙ্গলা, মৃত্যুঞ্জয়, মুক্তেশ্বর- তালধ্বজেও থাকে ৪ ঘোড়া

- সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন- রথে সুভদ্রার সঙ্গী সুদর্শনা-দর্পদলনের উচ্চতা ৪৩ ফুট- এই রথে মোট ১২ চাকা রয়েছে- লাল এবং কালো কাপড়ে সাজানো হয় রথ- দর্পদলনের সারথির নাম অর্জুন- দর্পদলনের মাথায় থাকা পতাকার নাম নদম্বিকা- রথের রশির নাম স্বর্ণচূড়া নাগুনি- সুভদ্রার রথে থাকেন ৯ দেবী- এঁদের মধ্যে রয়েছেন চণ্ডী, চামুণ্ডা, বনদুর্গা, শুলিদুর্গা, শ্যামাকালী, মঙ্গলা, বিমলা- সুভদ্রার রথকেও টেনে নিয়ে যায় ৪ ঘোড়া) করে জগন্নাথদেবের মন্দিরের সামনে 'বড়দাণ্ড' নামক প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর দিকে  গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।


প্রাচীন রীতি অনুসারে বিগ্রহ রথে তোলার পরে ওড়িশার গজপতি রাজবংশের প্রতিনিধি পথ পরিষ্কার করেন সোনার ঝাঁটা দিয়ে। প্রভু জগন্নাথের এই সেবাকে বলে ছেরাপহরা। রথ টেনে আনা হয় বলগণ্ডি। জগন্নাথদেবের মন্দির ও গুণ্ডিচার প্রায় মাঝামাঝি জায়গার নাম 'বলগণ্ডি'। রথের মাঝেই এখানে বিশ্রাম নেন পূজারি, সেবকরা। বিশ্রাম নেন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রাও। একটু খাওয়াদাওয়া হয়। একে বলে 'বলগণ্ডি ভোগ'। সেই বিশেষ ভোগে থাকে সুমধুর পানীয়, নানা ধরণের মিষ্টান্ন, খেজুর, আখ, নারকেল, কলা, প্রিয় ফল, ক্ষীরের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি, সুবাসিত শীতল জল, কর্পূর ও লবঙ্গ দিয়ে তৈরি সুগন্ধি মশলা পান ছাড়াও অসংখ্য উপকরণ। এর পরে গুণ্ডিচা বাড়ির দিকে চূড়ান্ত যাত্রা।

সেই সময়ে মহালক্ষ্মীকে তুষ্ট করার জন্য জগন্নাথ আবার তাঁকে ‘আজ্ঞা মালা’ (সম্মতির মালা) উপহার দেন। মহালক্ষ্মীকে ক্রুদ্ধ দেখে সেবকেরা গুণ্ডিচার প্রধান দরজাটি বন্ধ করে দেন। মহালক্ষ্মী অন্য একটি দ্বার দিয়ে প্রধান মন্দিরে ফিরে আসেন। ‘হেরা গোহরি’ নামে একটি পথ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। এরই নাম হেরা পঞ্চমী।


অসাম্প্রদায়িক দেবতা____ তবে কেন আমরা দলাদলি, রং অরাজনৈতিক জায়গায় রাজনীতির ছাপ ফেলে আমিত্বকে বড়ো করার প্রচেষ্টায় উঠে-পড়ে লেগেছি। কিসের জন্য?অস্তিত্ব কি সত্যিই সংকট জনক? তবে সরে আসি।অন্য যে আমার থেকে সুপিরিয়র আমি হয়তো ইগোর জায়গা থেকে মানতে চাইছি না।
ভাবুন। দেখুন এই যে রথযাত্রার আড়ম্বর---কেন? আনন্দ,আশা, সম্প্রীতি রঙিন আর মনুষ্যত্ব।এই তো!____তাই না!
"জগন্নাথ" কথাটি তৎপুরুষ সমাস। 
"জগন্নাথ" শব্দটি "লোকনাথ" শব্দটির মতোই একটি বর্গনাম। আসলে যে দেবতাকেই সর্বোচ্চ জ্ঞান করা হয়, তাঁকেই "জগন্নাথ" বলা চলে। 

ওড়িয়া ভাষায় "জগন্নাথ" দেবের মূর্তির গড়ন অনুসারে তাঁর "কাল্য" (অর্থাৎ, "কালো দেবতা" বা "কালের দেবতা"), "দারুব্রহ্ম" (অর্থাৎ, কাষ্ঠরূপী ব্রহ্ম), "দারুদেবতা" (অর্থাৎ, কাঠের দেবতা), "চকাক্ষী", "চকাদোলা বা "চকানয়ন" (অর্থাৎ, যে দেবতার চোখ গোলাকার) নামেও প্রচলিত। জগন্নাথের মধ্যে বিষ্ণুর সকল অবতারের চিহ্ন আছে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁকে বিষ্ণুর এক-একটি অবতারের মূর্তিতে পূজা করা হয়। বার্ষিক রথযাত্রার সময়ও জগন্নাথকে বামন রূপে পূজা করা হয়। 
                 কাহিনী অনুসারে, এমনও শোনা যায় বৃন্দাবনে গোপীরা একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাঁদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিলেন। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে নিয়োগ করা হয়েছিল গোপীরা যখন কৃষ্ণের কথা আলোচনা করেন তখন কৃষ্ণ যেন তাঁদের নিকটবর্তী না হতে পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য। কিন্তু গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতি দেখে পরিতুষ্ট সুভদ্রা তাঁদেরই কথা শুনতে শুনতে বিমোহিত হয়ে গেলেন। দেখতে পেলেন না যে তাঁদের দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিয়ে আসছেন। শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে এল, চোখদুটি বড় বড় হয়ে গেল এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে উঠল। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এইপ্রকার রূপ। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করেন।


আবার বহুল ভাবে প্রচলিত কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানী সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানী কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।  মূর্তির হাত-পা তখনও তৈরী হয়নি বলে রাজা বিমূর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধা পড়লো, অনুতাপ করতে থাকলেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।



তাহলে কি তিনি ঠুঁটো জগন্নাথ?  না... কারণ একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন একহাতে চক্র আর অন্য হাতে শঙ্খ আছে।আমাদের বিশ্বাস উনি আমাদের রক্ষা করার জন্য সর্বদাই তৎপর।কারণ উনিও জানেন ওনার সন্তানেরা সকলেই বিপদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে।সময়.....কাল...নিয়ে চলেছে এক অজানা খাদের দিকে।সন্তান খারাপ কাজ করলে তাকি কি ফেলে দিতে পারে পিতা হিসাবে? না। শুধরে নেন।আমাদের ও তিনিই শুধরে নেবেন। তবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে বই কি!জ্ঞানত তেমন কাজে নিজেদের লিপ্ত না করে চলুন সুস্থ স্বাভাবিক একটা সমাজ গড়ে চলি।
         রথযাত্রা হিন্দু সমাজের একটি বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের ২য়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর সাতদিন পর শুক্লপক্ষেরই দশমী তিথিতে রথের ফিরতি টান অনুষ্ঠিত হয়। একে বলা হয় উল্টোরথ। পুরনো কোন কোন লেখায় পাওয়া যায়- বৌদ্ধ সামাজিক উৎসবে রথে করে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে পথ পরিক্রমা করা হতো। ‘ফা-হিয়েনের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে বৈশাখী পূর্ণিমায় রথযাত্রার কথা পাওয়া যায়। নটরাজ শিবের মূর্তি নিয়ে কর্ণাটে (ভারত) রথ ভ্রমণে প্রথা আছে পৌষালী পূর্ণিমার চারদিন আগে।’ তবে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সর্বত্র রথারোহী দেবতা হলেন প্রভু জগন্নাথ, সঙ্গে বৈমাত্রেয় ভাইবোন বলরাম ও সুভদ্রা। তবে অনেক স্থানেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহের অভাবে রাধা-মাধব তথা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ রথে স্থাপনপূর্বক রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

রাজ-কর্মচারীবৃন্দ রথের রশি ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগে টানছেন কিন্তু রথের চাকা অনড়। খবর পেয়ে দেশের রাজা প্রতাপ রুদ্র সপরিষদ এসে রথের রশি ধরে আকর্ষণ করতে লাগলেন; তথাপি রথের চাকা স্থির, নিশ্চল। তখন মহাপ্রভু বললেন- যে শবর বা নিম্ন বর্ণের মানুষদের তোমরা অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছ, তাদের রথের রশি ধরার সুযোগ দাও, তোমাদের শক্তির সঙ্গে ওদের শক্তিও যোগ কর তাহলেই রথ তার গতি ফিরে পাবে। অনেক টালবাহানার পর সমাজে পিছিয়ে থাকা অচ্ছুৎ অন্ত্যজদের রথের রশি ধরার অনুমতি মিলল। সমাজের অন্য সবার শক্তির সঙ্গে যে মুহূর্তে যোগ হল তথাকথিত অন্ত্যজদের শক্তি- সবাইকে অবাক করে দেবতার রথের চাকা তখনই সশব্দে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।


রথযাত্রার উদ্দেশ্য  হোলো অগ্রগতি। চাকার অগ্রগতির সাথে মন মানসিকতার অগ্রগতি। আমরা জনি রথের চাকা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, মানেই সমাজের অগ্রগতির পথ এগিয়ে চলেছে।সে তো ভারতের পতাকার অশোকচক্র ও অগ্রগতিরই প্রতিক।কিন্তু দলাদলি কাদা ছোড়াছুড়ি করে অগ্রগতির নামে কি করছি? আমরা কি জানি না? বুঝতে পারছি না? সব গোচরে।আসলে জ্ঞান পাপী। কিছু প্রতিবাদ করতে গেলেই রাশ ধরে টানে সংসার,বৌ আছে বাবা-মা বৃদ্ধ, সন্তানের ভবিষ্যৎ।তবে যারা স্বাধীনতা আনলো? তারা ভাগ্যিস নেই।উঁচু উঁচু মূর্তি মোড়ে মোড়ে সাজিয়ে রেখেছি। বছরে একদিন পরিস্কার করা হয় আর মিডিয়ার সামনে ঘটা করে মাল্যদান হয়।
        সামগ্রিক বিচারে রথযাত্রা হলো সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজের কোন অংশকে অপাঙ্ক্তেয় করলে, অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রাখলে সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার গতিও রুদ্ধ হয়ে পড়ে; সমাজ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজ তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে সমাজের উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তবেই সমাজ সামনে এগিয়ে চলে। এক কথায়, রথযাত্রা মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায়, সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সমষ্টিগতভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। এই হল রথযাত্রার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। আমার সামান্য জানা আপনাদের সাথে ভাগ করলাম মাত্র।


সম্পাদিকা বন্ধুসম সুপ্রীতি বর্মনের বিশেষ ইচ্ছাকে প্রাধান্য জানিয়ে লিখলাম। শুধু সুস্থ সমাজ হোক এটাই কাম্য।আমরা ছোটবেলায় সারাটাদিন রথতলায় খাওয়া-দাওয়া মাচায় তোলা সময় কাটাতাম।আমি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা।আমাদের মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর গুপ্ত বৃন্দাবন নামে পরিচিত। কথিত আছে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাকে শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্নাদেশ দেন যেন বিষ্ণুপুর বৃন্দবন হিসাবে জগতে পরিচিত হয়।শর্ত ছিল বৃন্দবন থেকে যে রথ বিষ্ণুপুর আসবে তা বিষ্ণুপুর ঢোকার আগেই যদি ভোরের কাক ডাকে তবে রথ সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হবে।কালের চক্রে রথ নগরদ্বারের ৫০ মিটার দূরে কাক ডাকলো।চাকা ওখানেই প্রতিষ্ঠিত হলো।তাই গুপ্ত বৃন্দবন।আমাদের রথ পিতলের। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চ। ওখানে রাধলাল জিউ কে বসানো হয়।তাই আমরাও চাই আমাদের উত্তরসূরিদের একটা গর্বের ভবিষ্যৎ দিয়ে যেতে,,, যাই হোক এটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য।
  ভালো থাকুন।
  কবিতায় থাকুন।

হুমায়ুন কবীর মন্ডল,,,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


কবিতা: নীল (কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা)

নাম: হুমায়ুন কবীর মন্ডল

আমি ভালোবাসতে পারি না, তাই:
মাদাম তুসোয় জায়গা হবে না কোনদিন
টেরাকোটা ছুঁয়ে দেখেছি বারে বারে
মুচকি হাসে শপিং মলের মেয়েটি

সোনারপুরে বন্যা হলে
ভিজে গেল চপ্পল জোড়া
তোমার পাশবালিশে তৈরী হল
আর একটু ব্যবধান

আলোকবর্ষ ক্লান্তি মেখে টহল দিই
নীলবাতি হাতে শয়নকক্ষের ঘাম
ডিম লাইটে দেখতে পেলাম
আদিম রিপুর সহাবস্থান,,,,




হুমায়ুন কবীর মন্ডল,,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


কবিতা: জিঘাংসা (কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা)

নাম: হুমায়ুন কবীর মন্ডল


আমি তোমার কথা ভাবতে থাকি
গহীন রাত্রির প্রতিটি শিরা উপশিরা ভেদ করে
যখন কাল পেঁচা ডেকে ওঠে
রাতপুরীর প্রত্যেকটি কীট চুপিচুপি
জানিয়ে দেয় ভয়ংকর সব অভিলাষ
সম্মোহনী প্রদীপটাও নিভে গিয়ে
আর্ত চীৎকার করতে থাকে।।

অন্ধকার ফেনায়িত হয় - পাহাড় সমতলে
সমুদ্র নীল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে
কালনাগিনী খুঁজে পায় মেঠো ইঁদুরের সংসার
মহাশ্মশানের নিদারুণ স্তব্ধতা
উঁকি দেয় গৃহস্থের সংসারে
বাতি জ্বেলে জ্বেলে ক্লান্ত জোনাকির
শেষ রোশনাইটুকু গিলে ফেলে এই মহারাত্রি।।

ভাবতে থাকি তোমার কথা অপরাজিতা,
দীর্ঘ জনপদ পার হয়ে সন্ত্রস্ত পশুগুলো
মাটি স্পর্শ করতে চায়
কংক্রিটের মতো ধাতব শব্দ ফিরে আসে
মূর্তিমান হাহাকারের মত
হালুইকরের ছেঁড়া গামছার তিতকুটে স্বাদে
ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় মাছির পাল
অপরাজিতা, আর ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না।


হুমায়ুন কবীর মন্ডল,,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা



কবিতা: খুব সত্যি (কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা)

নাম: হুমায়ুন কবীর মন্ডল


আদমসুমারীতে যুক্ত হ‌ওয়া আমি ময়ূরপুচ্ছ ধরে চৌরাস্তা ধাওয়া করি
জুলজুলে চোখ আমার অহং এর অনুঘটক
সে চীৎকার করে বলতে থাকে - আমি স্বভোজী
আমার অবাধ গতি অবরুদ্ধ করে, একটি ফোস্কা
ম্যানহোলের গন্ধ লেগে থাকে তোমার নাকছাবি
কুড়ি বাইশের পার্কস্ট্রীট, সঙ্গমে মাতে বালিয়াড়ির
দেদার লুন্ঠনে খাঁচাটা ভর্তি, - দুষ্প্রাপ্য সঞ্চয় যখন-
হরেক মাল দশ টাকার ফেরিওয়ালা কে আমি চিনি-
সিংহ মুখোশ পুষে রাখে লোকটা

সদ্য স্নান করার পর আমি আমার থেকে অনেক দূরে - গন্ধ ঢাকে পারফিউম
সন্তানপূর্বের যৌনতাটুকু, - সারসত্য নয় কি?
কাজল পড়া নরনারী গির্জা বাঁধে
অযুত নিযুত প্রান্ত থেকে জলছবি রাস্তা কাটে
সকলের তরে সকলে আমরা, - এই ধাপ্পাবাজি টুকু-
পকেটমার কোনদিন পেরে উঠল না
গ্রন্থপাঠের সময়টুকু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হলে
সানুনাসিক থেকে থুত্তুরে হয় উচ্চারণ


বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

হুমায়ুন কবীর মন্ডল,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


কবিতা: অভাগীর বিপরীতে (কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা)

নাম: হুমায়ুন কবীর মন্ডল


রাত বারোটার পর বাকি পুরুষের থেকে
হ্যাঁ আমার পার্থক্য যৎসামান্য
আমার দেশ নেই, জ্ঞাতি নেই
তবে - একটা তরঙ্গ আছে

শামিয়ানার নীচে লুকিয়ে থাকে মাংসপিণ্ড
আর‌ও নীচে ধবধবে কতক প্লেট
উষ্ণতা সাজিয়ে রাখে হারেম সেনা
শীতবস্ত্র ভিজে যায় যখন আমি তুর্কি তরুণ
রাত বারোটার পুরুষ হবার সৌভাগ্য,

সুমেরু থেকে সুদান
জাকার্তা থেকে জায়ফল - চুকচুক করে
দীঘল প্যাঁচালো জিভ
দন্ডধারীর মুন্ডে আর একটি পালক
মোনালিসার পোট্রেট ভেঙে পড়ে
কেবলমাত্র রহস্য থাক হরপ্পা সভ্যতায়
বিজয় তোরণ হাতে খনন করি
বাকি আছে কামাখ্যা দেবীর পুংলিঙ্গ

উত্তর থেকে দক্ষিণ, আমি যেখানে ফসল ফলাই
পূর্ব থেকে পশ্চিম -
গাদা বন্দুকে ভিড় করে আমার সাগরেদ
বিদুষী আকাশ‌ও একদিন দাঁড়িয়ে থাকে
সোনাগাছিতে আসছে গেটস পত্নী

আমার সময় নেই ফেরিওয়ালার গুরুভারে
শীতের দেশে বাতাস ওঠে ডাক শুনে
জোকোকাবাদে আর‌ও এক টুকরো সূর্য
পাহাড়ি মেয়ে কান্না চাপে - হৃদস্পন্দন
অথচ বুলগেরিয়ার রানি ও আমি সাবান মাখি




সৌমেন গুহ রায়,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


সৌমেন গুহ রায় এর কবিতাগুচ্ছ

(কিশোরী প্রণয় ও রথযাত্রা )


প্রথম কবিতা

স্পর্শাতীত আশ্রয়ে পড়ে আছি আজ ও
অথচ কী দারুণ আগ্রহে
এই নিমতিতা গ্রহে
শুধু তোমাকে ছোঁবো বলে উনুন ভাঙিনি এখনো

পান খসে চাঁদ ভাঙে আদমসুমারী শেষে
বর্ণমালা ছানে
শরীরী শ্লোকে তখনো মুহ্যমান
অযোনিসম্ভবা

সারারাত খুঁজে মরে অন্ধ জোনাক


দ্বিতীয় কবিতা,,,

তোমার প্রণয়সাজ অহল্যাদর্পণ ধুলায় লুটায়
আমি অন্ধকার হতে গাঢ় কোন
অববাহিকায়
হেঁটে যাই
অপুষ্ট নক্ষত্রের খোঁজে

হে আরিত্রিকা আমায় যূথবদ্ধ করো
খুলে ফেলো কেশদাম
স্তন্যবৃন্ত দাও মুখে
যোনিদ্বারে দাও অবাধ অধিকার
নিগূঢ় রহস্যে রেখো না নিজেকে

বিদায়বাদ্য নয় বিসর্জিত অক্ষর সাজে
আজ সাজাবো তোমাকে শেষ অহংকারে



তৃতীয় কবিতা


যা জানার নয় তাও কী জেনেছিলাম
অনিবার্য কৌতুহলে 
জ্যোৎস্নায় কুয়োতলায় পরীদের স্নান দেখে
বেপথু হয়েছি বারবার
ঋতুমতী মেঘের শরীরে 
বজ্রের বলাৎকার দেখে বেহায়া বোষ্টুমীকে                ডেকেছি ভাঙা মন্দিরে

যা হবার নয় তাও হয়েছি ঘুঘুডাকা দুপুরে
ছেনালি বৃষ্টি ছেনেছি দু'হাতে

এ প্রৌঢ় পোয়াতী মেঘের সম্ভাবনায় ভাসে আজ ও


চতুর্থ কবিতা

প্রহরের পঙক্তিতে পঙক্তিতে ব্যর্থ রেতঃপাত
সময়ের কাছে আছে সেই সমাচার
বয়ঃসন্ধির কোন নিষিদ্ধ পটভূমি নেই
রহস্যের স্রোতধারা,উদাসীন নদী
প্রমোদে প্রমাদে কত কবিতার জন্ম হয়
স্বপ্নের সুড়ঙ্গে পথে কোন প্রতিরক্ষা নেই
অন্তর্বাসে শুধু ছায়াচিত্র আঁকে,সমুদ্র স্নানের

ও'ই ওম মেখে নিয়ে সমস্ত শরীরে
অসৈরন বৃষ্টি দেখে বালক বালিকা
ভাসবে নাকি,ভেজায় যদি ইচ্ছে সকল
গোপন অঙ্গে মাখামাখি,শিহরণ
কুয়াশার পান্ডুলিপি,বুকের বকুল ফুল
শ্যাওলা পেরিয়ে ভাসে সন্ধ্যাসায়রে

আটপৌরে সংসারে সে এক অলৌকিক স্পর্শকাতরতা
বিপন্ন মেঘের জলে
অজান্তেই ভিজে যায়,ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়
নিষিদ্ধ নগ্নতা তখনো সাবালক নয়


পঞ্চম কবিতা

তুমি তোমার ডান স্তনে মুখ রাখতে ডেকেছিলে
সুডৌল বাঁ স্তনে হাত বাড়াতেই
তুমি সরে গিয়ে 
ওটা ঈশ্বরের জন্য
রোজ রাতে উনি আসেন

সেই থেকে আমি ঈশ্বর হবার প্রযত্নে 
শশাক্ষেত পানাকেশে আচ্ছন্ন জলাশয় উন্মুখ পর্বতমালা
আর সৈন্ধব লবণে খুঁজে ফিরছি সেই পরম প্রতারক কে

গ্যেটে দান্তে মার্কস ছেড়ে আমি ইবলিসকে  বন্ধু মেনেছি আজ


ষষ্ঠ কবিতা

এবার আসি
কোলাহল তো অনেক হয়েছে
এখন মৃতভোজীদের উৎসব শুরু হবে
সমুদ্রসারল্যে হারিয়েছে সমস্ত আদ্যাক্ষর

তুমি বরং তোমার নতুন শিকারের সন্ধানে খুলে দাও তোমার বুকের আঁচল


সপ্তম

আলাপচারিতায় ছড়িয়ে রইলে তুমি
ঝরলে না
শিথিল সম্ভোগে খুললো না গুহামুখ
অপটু করতলে তখন উন্মুখ
জোড়া চাঁদ
আলুথালু আঁচলের আড়ালেই রইলে 

আকাশ কী লুপ্ত হবে আজ
হিম পড়বে না আর
পাখিরা ভুলেছে উড়ান
শোকার্ত মাছেরা উৎসমুখ খোঁজে 

জোনাক জ্যোৎস্নায়
সন্তাপ নয় আরো একটু উত্তাপ দাও


অষ্টম

খড়ের বাঁধনের সকল কর্কশতা 
মুছে গিয়ে
মূর্তিকরের পেলব লেহনে ফুটে উঠছে সেই 
ভরভরন্ত স্তন নাভিবর্ত
নিতম্ব  
লন্ঠনের আলোয় তখন দোচালার নীচে অন্য 
দৃশ্যপট

পিছনে দাঁড়িয়ে তখন বৌঠান 
ছলছল চোখে আগলে রাখছে নিজেকে
অকালবোধনে দুধে নুয়ে আছে সে নাবাল ক্ষেত

চক্ষুদানের সময় তাকেইতো ডেকেছে আজ

শিউলি ঝরে পড়ছে সমস্ত উঠোন জুড়ে রাতভোর


নবম

সিঁথির শৈথিল্যে হারাই হাজার উঠোনে
তুমিতো সম্পূর্ণ নয়
কী দেবে আমায়
কিছু বিহ্বলতা শঙ্খনাদ ত্বকের গঠন
যোজনায় আশ্চর্য আহ্লাদ
উদ্বেল মুহূর্তের প্রান্তিক আশ্রয়
ডেকে ওঠা সঙ্গমের অনুচ্চার ছড়  

প্রলম্বিত পৌরুষের শেষ আচ্ছাদন নগ্নজোছনায় 

বারদুয়ারির পথতো তুমিই চিনিয়েছ



উজান উপাধ্যায়,,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


অপাপবিদ্ধ (কিশোরী প্রণয় ও রথযাত্রা)

উজান উপাধ্যায়


ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি শহরতলির সান্ধ্য জঠরে, হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে হলুদ নিয়ন-

ক্রমশ গিলছে চোরাবালি, প্রেয়সীর চোখ জিভ আদিম ওষ্ঠভাঁজ মৃদঙ্গ বাজিয়েছে উদগ্র সিম্ফনির চলকে পড়া হারমনিক্স ছুঁয়ে।

আমাদের এই সব সর্বনাশ অন্ধকার লুটেপুটে খায়, আমাদের গভীর প্রশ্বাস বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তৃষ্ণার্তের বিবরে রাখা তৃপ্ত হরিণীর মতো।

ক্রমাগত মরে যাচ্ছি আমরা দুজন, পৃথিবীর সব নীল
আমাদের দুজনের নিঃস্বতার কাঁধে শিকারি রাতের সব নগ্ন আস্ফালন জড়িয়েছে বিনিদ্র কুয়াশার মতো।

এই যে প্রেমজ তিমির আমাদের যৌথ হত্যার, মাইল মাইল দূরে ঝরে যায় আদুরে ছায়ায়-

এইভাবে একটি  জন্মের অনস্বীকার্য ভুল ভালোবাসার পোশাকহীন লয়ে অপাপবিদ্ধ হয়ে যায়।


সুতনু হালদার,,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


রহস্য (কিশোরী প্রণয় ও রথযাত্রা)

 সুতনু হালদার

তারপর থেকেই এক এক করে আমি প্রতিটা মেঘের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলাম, প্রতিটা মেঘ তখন ভাসছে ওদের আকাশে, সেই আকাশ তখনো আমার ছিল না; আমি আর আকাশ ছিলাম বিপ্রতীপ

কিন্তু প্রবহমানতার আবদার ছিল ভয়াবহ, ভয়ঙ্কর ছিল বহুত্ববাদের নৈমিত্তিক চাহিদাগুলো! যাবতীয় বিপ্রতীপতা একদিন বিচূর্ণ হ'ল, সত্তার নিক্তিতে টানাপোড়েন অস্তিত্বের প্রশ্নে বড্ড অনড়

আমি আর আকাশ বন্ধু হয়ে গেলাম! যে অভিযোজন মানুষ করে এসেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, সেই অভিযোজন খিদের মতো গ্রোগ্রাসে ছুটে এলো প্রতিটি সিজিন্যাল ফ্লাওয়ারের ক্লিভেজ চুরমার করে; বন্ধুত্বের অমোঘ ব্যঞ্জনার আড়ালে শ্রমিকের ঘাম লেগে থাকে...

কয়েকটা বন্ধনীচিহ্ন প্রশ্নবোধক হয়ে বারবার খোঁচা দ্যায়, কয়েকটা তর্জনী নিজের স্পর্ধা আর নিজের এক্তিয়ার ভুলে যেতে যেতে একদিন আকাশ হয়ে যায়

এই আকাশ আবার আমার অচেনা কুঠুরিতে কোন অষ্টাদশীর মতো রহস্যময়! জীবনে অনেকগুলো অদৃশ্য প্লাটফর্ম থাকে বলে ঋতুবৈচিত্র্যে  মানুষ দিশেহারা হয়ে চাঁদের গলনাঙ্ক  চেখে দেখতে দেখতে পরের প্রজন্মের জন্য পোড়া মাংসের গন্ধ রেখে যায়



সুখবিন্দর সরকার,,,, কিশোরী প্রণয় রথযাত্রা


অন্তসার জলিস (কিশোরী প্রণয় ও রথযাত্রা)

          সুখবিন্দর সরকার


তুমি রাত ছুঁয়ে দিও কম্পাস মজলিসে
নিদেন ছবি এঁকে যায় বন্ধাত্বের চোখ

বারান্দা ছুঁয়ে থাকা নোনতা স্বাদের
মিছিল জেগে ওঠে
একবুক ঐশ্বরিক অভিশাপ...

তোমার বুকে অক্ষত শ্রমিক
গোপন রাখে শতাব্দীর শোক
দেওয়াল ভেঙে জেগে ওঠে
গর্ভবতী মেকাপ

রাত চেনা দায়হীন করিডোর
পথের সংলাপ নারী-হীন সতীত্বে বিভোর

তোমার অপেক্ষায় খোরাকি দিন সব
ধুয়ে রাখা স্বপ্নের মহড়ায়

cleyarence



দুপুর দিনের এক্সরে

         সুখবিন্দর সরকার


দু'আঙুলে যুক্তাক্ষর জমি
তোমার দখলে
মায়াবী হরিণ দাঁতের আড়ালে
কড়াত ভেঙে চলে

একটা ফুটন্ত উপন্যাস জংধরা ইতিহাস রচে ভাতের হাঁড়িতে
চোখ রগরায়  ছিন্ন সীমানায়
মায়ের নক্সা আলতো পিঠে
বেনারসি হাট

ফুলের আড়ালে রঙ-চটা ঢেউ
তোমার পায়ে আলতা হয়ে ওঠে
চুমুর আকাশে বিরহ বাজায় কাতিল
দিনের চাঁদ


সম্পাদকীয় কলম--সুপ্রীতি বর্মন


উপসংহার,,,,,

(( "বিদ্যাসাগর স্মৃতিকথা" গ্রন্থ থেকে এই অংশটি সংগৃহীত। এই প্রেক্ষাপটের সাথে প্রাসঙ্গিক আমার কিছু পর্যালোচনা"))


সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাতে তুমি দীর্ঘজীবী হলে কখন‌ই সুখ ও স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রার সমাধান করতে পারবে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কর্মেন্দ্রিয় এর শৈথিল্য আসবেই এবং উপযুক্ত মনোবল না থাকলে এই নৈরাশ্য ও হাহাকার এড়ানো অসম্ভব। দেহ যখন দেহধারীর বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন মনকে এক দেহাতীত আদর্শের আকাশে স্থাপন না করে উপায় নেই। তিনি মানুষের দুঃখ দেখলে আবেগের আতিশয্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বেও প্রশ্ন তুলতে সাহসী হয়েছেন,,,,,

আজ সেই মনীষীর ভগ্নদশা ঈশ্বর বোধে নিজেই একটা অনিশ্চিত ভবিতব্য এর মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে আছে,,, সকল মানুষের কর্মেন্দ্রিয় তে হয়ত শৈথিল্য এসে গেছে যে ঐ ঘটনা ঘটে যাওয়া কেউ আর আটকাতেই পারলো না,,, দেহ যেটা একটা বিরাট বিড়ম্বনা তাকে পরিত্যাগ করে দেহাতীত আদর্শেই তার মহান আত্মা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। সংরক্ষিত যার ছোঁয়া পেতে অসীম মহাকাশ শূন্যতা বুকে ধরে রাখতে হয়,,, যেটা হয়ত আমাদের মতন নগন্য মানুষের সীমারেখার অনেক উর্ধ্বে,,,, তাই এই মূর্তি ভেঙে যাওয়াই বোধহয় ভালো,,, কারণ তা গ্রহণ করতে আমরা সম্পূর্ণরূপে অপারগ,,,,

বিদ্যাসাগর দুঃসহ আঘাত পেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই বেদনা বহন করেছিলেন। তিনি নৈরাশ্যগ্রস্ত  pessimist  ছিলেন বলেই আখ্যাতি লাভ করেছেন।তার বেদনা ছিল দেশের কাছ থেকে সেখানে তিনি শান্তি পাননি। তিনি তাতে কর্তব্যভ্রষ্ট হননি, কিন্তু তাতে তার জীবন বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। বড় তপস্যার দিকে স্বদেশীদের কাছেও কোন অভ্যর্থনা পাননি।

মহাপুরুষেরা হয়ত না পাওয়ার গৌরবের দ্বারাই ভূষিত হন।বিধাতা তাদের যে দুঃসাধ্য সাধন করতে সংসারে পাঠান তারা এই দেবদত্ত দৈত্যের দ্বারাই অন্তরের মধ্যে সম্মান গ্রহণ করেই আসেন। বাইরের অগৌরব তাদের অন্তরের সেই সম্মানের টীকাকেই উজ্জ্বল করে তোলে,অসম্মান‌ই তাদের পুরস্কার,,,,
আর সাধারন মানুষের ক্ষেত্রে সাধনায় সামান্য না পাওয়ার শোক নিয়তি ও নির্যাতনের হাহাকারে  জীবন কে বিষাদান্ত করে তোলে। বিভ্রান্তির বোধ তাকে অনুশোচনায় দগ্ধ করে মারে আর তার আত্মিক ভারসাম্য খোয়া যায়,,,,

বিদ্যাসাগরের অস্তিত্ব ঐ আঘাতে বিন্দুমাত্র খন্ডিত হয়নি আর কোনদিন হবেও না,,, কারণ তার আদর্শ হল দেহাতীত,,,, জগৎ-তত্ত্বই তার সাধনার অবলম্বন ছিল,,, সেখানে আত্মতত্ত্বকে তিনি যদি বর্জন না করে চলতেন তবে অতলান্ত সমুদ্রবক্ষে জ্বালা যন্ত্রণার বিক্ষোভের পরিবর্তে অনাসক্তির নিস্পৃহতাই দেখা দিত না কি নিশ্চল শান্তির তারল্য?

তাই তার প্রাপ্তিযোগ নিয়তির কালরাত্রির দুর্যোগে কিঞ্চিৎ হলেও তার মান সর্বত্যাগী ও অক্ষুণ্ণ আছে এবং থাকবে সকল বাঙালীর মনে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই,,,,


সমস্যার মীমাংসা,,,, সমাধান সূত্র,,,,

#######################

একদিকে লোকে অন্ধবিশ্বাসের অধীন হয়ে আপন ভাগ্যের নিন্দা করতে করতে অলসভাবে তাদের দিনযাপন করতে থাকে। জাগতিক কি ঘটছে বা আসন্ন আগামীতে কি ঘটতে পারে সেটার ইঙ্গিত ঐ যতটুকু নিউজ হেডলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়া গুছিয়ে  garnishing  করে মুখের সামনে ধরে দেয় ততটাই আত্মকেন্দ্রিক সুখে গ্রহণ করতে থাকি। বাকি কি হচ্ছে না হচ্ছে তার প্রতি উদাসীন থাকাই সংসারের পক্ষে মঙ্গল,,,,

অপরদিকে নতুন ভাব ও নতুন উদ্যমের খরস্রোতে শিক্ষিত বাঙালী যুবকদের আদর্শহীন অজ্ঞাতপথে নিয়ে যাচ্ছিল কারণ তাদের  মাথার উপর কোন নির্দিষ্ট পথপ্রদর্শক নেই বা তার অভাব যথেষ্ট রয়েছে,,, যেটা এক জটিল ধাঁধা,,,,

সেখানে বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রের দরজায় দাঁড়িয়ে নতুন বিদ্যাসাগর দেখলেন,,,,মূর্তিমান মনীষী আদর্শের এক স্মৃতিসৌধ স্মারকে দাঁড়িয়ে থ হয়ে,,,, কি সব ঘটে চলেছে চতুর্দিকে কেবল এক নৈরাজ্য স্বার্থান্বেষী খাওয়াখাওয়ি আর নৈরাশ্যের ঘন ধুম্রকালো জটাজুট এলোকেশে সর্বস্বান্ত মাতৃভূমি,,,,আমার সোনার বাংলা।

একপাশে রাজনৈতিক দলাদলি আক্রোশে আক্রমণাত্মক পারস্পরিক হিংসা ও হানাহানি,,, আবর্জনাপূর্ণ যেন কোন বিশাল অরণ্য,,, বহু রত্নের আকর হয়েও অজ্ঞাত ও কুসংস্কারের দৃঢ় নিগড়ে পরিবেষ্টিত,,,,

অপরদিকে বিচিত্র দৃশ্য সমুদ্র বক্ষ নিষ্পাপ ও নিশ্চল সাহিত্য ও সৃষ্টি সাধনার যেখানে রয়েছে হৃদয়গ্রাহী নান্দনিকতা ও সৌন্দর্য আর এক অপার অগাধ প্রশান্তি,,, কিন্তু তার মধ্যেও চাটুকারিতা ও পদলেহনের কর্কট কিংবা বৃশ্চিক,,,, আর রয়েছে সর্বগ্রাসী লোভের তিমি ও মকর যাদের অন্তহীন সমুদ্রের তলায় গুপ্ত অবস্থান।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উভয়ের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে দিব্যনেত্রে তার ভাবী সংকল্পের পথ দেখাতে থাকলেন। আর উভয় বাধা বিঘ্নের মধ্য দিয়েও একটা সুদৃঢ়পথ তৈরী করে ছাড়বেন বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন,,, যে চেষ্টা আমরা এই জাগতিক দুর্বিষহ জীবনে ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে সমানে করে চলেছি আর পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছি বারবার।

প্রাচ্য কুসংস্কার ও পাশ্চাত্য আড়ম্বর পরিহার করে নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ণ বীরপুরুষের উপযুক্ত পথে তিনি অগ্রসর হতে লাগলেন। উভয়পক্ষের মন্দভাগ ত্যাগ করে রত্ন আহরণের চেষ্টায় মেতে উঠলেন। আর সেইভাবেই আপন জীবনের শোভা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বর্তমান জীবনের সমস্যার মীমাংসা করা যেতে পারে,,, আর হয়ত এই প্রচেষ্টায় একটা ঠিকঠাক সমাধান সূত্র পাওয়া যেতে পারে।।


সম্পাদকীয় কলম--সুপ্রীতি বর্মন


চতুর্থ ভাগ: কবিতা প্রশস্তি,,,,

(( বিদ্যাসাগর স্মৃতি গ্রন্থ থেকে কবিতাটি সংগৃহীত,,,))

সাগর- তর্পণ,,,,

লিখেছেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,,,,

(( আমার সংযোজন,,, এই অপুর্ব বিদ্যাসাগর প্রশস্তি সূচক কাব্যের সাথে আমার লিখিত খন্ডবিখন্ড অন্তরসত্য,,কিছু নিজস্ব কথন,,, ))

১,,,,,,

বীরসিংহের সিংহশিশু! বিদ্যাসাগর! বীর!
উদ্বেলিত দয়ার সাগর-বীর্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
তোমায় দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়।

নিজস্ব সংলাপ,,,,
(অন্তরসত্য),,,,,

((স্থবিরতায় সেদিন যে সাগর--‌অগ্নি ঘুমিয়ে ছিল মহান মনুষ্যত্ব আদর্শে জান্নাত সংরক্ষিত মৌন‌-ঈশ্বরচন্দ্র-সৌধে,,, তা হঠাৎ করালগ্রাসী শাসনতান্ত্রিক পুঞ্জীভূত ক্ষোভে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে এক তীব্র সাম্প্রদায়িকতার পদস্খলনে,,,, কি তীব্র তার আর্তনাদ হায় বাঙালী হায়,,, তুই শুনলি না বা শুনতে চাসনি একবার,,, তাই হয়ত জেগে উঠেছে অবিশ্বাসী প্রত্যয় আবার,,))



২,,,,,,

         নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এলে, দয়ার অবতার!
        কোথাও তবু নোয়াওনি শির,জীবনে একবার!
দয়ার স্নেহে ক্ষুদ্র দেহে বিশাল পারাবার,
সৌম্য মূর্তি তেজের স্ফূর্তি চিত্ত- চমৎকার।

নিজস্ব সংলাপ,,,,
(অন্তরসত্য),,,,

((অখন্ড পৌরুষ তুমি কোনদিন নোয়াওনি তব উন্নত শির আজ তবে কেন খন্ডিত শিরধ্বজা বিষণ্ণ আঙ্গিক,,, ভেঙে পড়েছে অপদস্থ ধূলিশয্যায়,,, তোমার ছিন্ন-‌চির উন্নত-শির))


৩,,,,,,

নামলে একা মাথায় নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ,
করলে পূরণ অনাথ আতুর অকিঞ্চনের সাধ,
বিঘ্ন-বাধা তুচ্ছ করে দৃপ্ত দুর্নিবার,
অদৃষ্টেরে ব্যর্থ তুমি করলে বারংবার।

নিজস্ব সংলাপ,,,,
(অন্তরসত্য),,,,

((ভাগ্যের কুচক্রী পাপবিদ্ধ শরাঘাত তোমার আদর্শে এনেছে আঘাত,,,, তাই ইচ্ছে না থাকলেও আজ দশচক্রে ভগবান হয়েছে ভূত,,, ভাঙন ও ঘুণ ধরতে লেগেছে তাদের হাড় মজ্জায়,,,,যেন জাতির নামে বজ্জাতি,,,, এ কেমন অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস))



৪,,,,,,,

বিশ বছরে তোমার অভাব পূরল নাকো, হায়
বিশ বছরের পুরানো শোক নূতন আজো প্রায়,
তাইতো আজি অশ্রুধারা ঝরে নিরন্তর!
কীর্তি-ঘন মূর্তি তোমার জাগে প্রাণের পর।

নিজস্ব সংলাপ,,,,
(অন্তরসত্য),,,,

(( আজ‌ও তুমি জেগে আছো ও থাকবে চির উন্নত পৌরুষ শৌর্যে ও পরম আত্মহুংকার বীর্যে,,, কোনদিন অভাব হবে না চাক্ষুষ করতে তোমার আদর্শ অমলিন,,,,কারণ তোমার অস্তিত্ব শুধু পথের ধারে কোন পাষাণপ্রস্তরে নয়,,, তুমি আজ‌ও জেগে আছো ও থাকবে বাঙালীর প্রাণের পর,,, কারণ তোমার আদিগন্ত ব্যাপী বিশালাকার করুণাসাগর সীমাবদ্ধ থাকতেই পারে না,,, কেবলমাত্র একটি মূর্তিতে,,,))



৫,,,,,,

স্মরণ-চিহ্ন রাখতে পারি শক্তি তেমন নাই,
প্রাণপ্রতিষ্ঠা নাই যাতে সে মূরৎ নাহি চাই,
মানুষ খুঁজি তোমার মত, একটি তেমন লোক,
স্মরণ-চিহ্ন মূর্ত! -- যেন ভুলিয়ে দেবে শোক।


রিক্ত হাতে করবে যেন যজ্ঞ বিশ্বজিৎ, -
রাত্রে স্বপন চিন্তা দিনে দেশের দশের হিত, -
বিঘ্ন-বাধা তুচ্ছ করে লক্ষ্য রেখে স্থির
তোমার মত ধন্য হবে, - চাই সে এমন বীর।


তেমন মানুষ না পাই যদি খুঁজব তবে হায়,
ধূলায় ধূসর বাঁকা চটি ছিল যে ঐ পায়,
সেই যে চটি উচ্চে যাহা উঠত এক-একবার
শিক্ষা দিতে অহংকৃতে শিষ্ট ব্যবহার!


সেই যে চটি দেশের চটি বুটের বাড়া ধন,
খুঁজব তারে, আনব তারে, এই আমাদের পণ,
সোনার পিঁড়েয় রাখবো তারে থাকবো প্রতীক্ষায়
আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দিগাঁয়।


শাস্ত্রে যারা শাস্ত্র গড়ে হৃদয়-বিদারণ,
তর্ক যাদের অর্কফলার তুমুল আন্দোলন,
বিচার যাদের যুক্তিবিহীন অক্ষরে নির্ভর,
সাগরের এই চটি তারা দেখুক নিরন্তর।


দেখুক, এবং স্মরণ করুক সব্যসাচীর রণ, -
স্মরণ করুক বিধবাদের দুঃখ-মোচন পণ,
স্মরণ করুক পান্ডারূপী গুন্ডাদিগের হার,
'বাপ-মা বিনা দেবতা সাগর মানেই নাকো আর।'

নিজস্ব সংলাপ,,,,
(অন্তরসত্য),,,,

(( অনেকটা দারিদ্র্য এর দুর্বিষহ যন্ত্রণা ও শোক বুকে চেপে করে গেছো দেশ ও দশের মঙ্গল,,,, নিজ লক্ষ্যে স্থির থেকে একাগ্র চিত্তে,,, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন,,,, যদি ঐ পাষাণপ্রস্তরে জাগে তোমার প্রাণ তাহলে হয়ত এই ঘোর অরাজকতার খান্ডবদহনে হাতে তুলে ধরতে আবার বাঙালী চটি আর পিটিয়ে পিটিয়ে সিধা করে দিতে পারতে ভেঙে যাওয়া মেরুদণ্ড এ দাঁড়ানো ক্ষণজীবী বাঙালী জাতি,,,, ঘুচে যেতো সকল মিথ্যা উচ্চকন্ঠী প্রতিবাদের আম্রকানন,,ভগ্নপ্রায় জাতির হাস্যকর আস্ফালন,,,, ))



৬,,,,,,

অদ্বিতীয় বিদ্যাসাগর!  মৃত্যু -বিজয় নাম,
ঐ নামে হায় লোভ করেছে অনেক ব্যর্থ কাম,
নামের সঙ্গে যুক্ত আছে জীবন-ব্যাপী কাজ,
কাজ দেবে না, নামটি নেবে? একি বিষম লাজ!


বাংলা দেশের দেশী মানুষ! বিদ্যাসাগর! বীর!
বীরসিংহের সিংহশিশু!  বীর্যে সুগম্ভীর!
সাগরে যে অগ্নি থাকে কল্পনা সে নয়,
চক্ষে দেখে অবিশ্বাসীর হয়েছে প্রত্যয়!

নিজস্ব সংলাপ,,,,,,
(অন্তরসত্য),,,,,

(( আশায় আছি আর আমার মায়ের ভাষায় আছি সুরক্ষিত থাকার সকল উপাচার যত্নে আগলে রেখে আলপথ ধরে যেন কোন কিছুর আঁচ গায়ে না লাগে,,,, আবার হয়ত আসবে একদিন সেই সুসময় যখন দৃপ্ত বজ্রকঠিন প্রত্যয়ে ভাঙা মেরুদন্ড সোজা করে অবিশ্বাসী বাঙালীর জাগবে বিশ্বাস,,,,বিদ্যাসাগর অপরাজেয় আপোষহীন পৌরুষে সাহসিকতার বর্ণপরিচয়ে দুর্বল মানুষকে দেবে ঘুরে উঠে দাঁড়ানোর মতন দুর্দমনীয় আত্মবিশ্বাস,,,,সেদিন আবার আমার জন্মভূমি জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করবে,,, ))



সম্পাদকীয় কলম--সুপ্রীতি বর্মন


তৃতীয় ভাগ:

(( এই অংশের লেখা অনুপ্রেরণা পেয়েছে আর সংগৃহীত হয়েছে,, "বিদ্যাসাগর স্মৃতি",,,এই গ্রন্থ থেকে))

বিদ্যাসাগরের অসীম আত্মসম্মান বোধ,,,,

খন্ডিত হয়েছে সেই প্রাককথন,,,,

খন্ডবিখন্ড তার মূর্তি আজকের জনহিতে কল্যাণকারী,,,এখনকার সৃষ্ট প্রগতিশীল সমাজে,,,

বিমূর্ত চিন্তা ও চেতনার আখর,,,,,


একদিন বিদ্যাসাগর কোন প্রয়োজনে সংস্কৃত কলেজ থেকে হিন্দু কলেজে কার সাহেবের সাথে দেখা করতে যান। কার সাহেব তখন তার কামরায় সামনের টেবিলের উপর জুতো পরে পা দুটো ছড়িয়ে চেয়ারে বসেছিলেন,,,, বিদ্যাসাগর কে দেখে পাদুটো নামালেন না আবার গুটালেন না,,, এতটাই তার ঔদ্ধত্য। তার চেয়ে সে বরং ঐদিকে যে চেয়ার আছে পায়ের আঙুলের নির্দেশে তাতে বিদ্যাসাগর কে বসতে বললেন। সেই অবস্থায় বিদ্যাসাগর কথাবার্তা সেরে চলে গেলেন,,,,

 ((মনে মনে হয়তো ভেবেছিলেন,,,, আমারো একদিন আসবে যেদিন তোমার অন্ধ আত্ম‌অহংকারী ঔদ্ধত্যের উচিত শিক্ষা দিয়ে তোমাকে বুঝিয়ে দেবো,,,, আমরা ভারতবাসী নেহাত অপ্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র দমে যাওয়া জাত নয়))


কিছুদিন পর কি প্রয়োজনে কার সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সাথে দেখা করতে যান। তখন বিদ্যাসাগর টেবিলের উপর তার তালতলার চটি শোভিত পদযুগল কার সাহেবের দিকে প্রসারিত করে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এরপর এই ব্যবহারে কার সাহেব অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে উপরিওয়ালার নিকট নালিশ করলেন,,,,

((নিজের কৃতকর্মের জন্য উচিত শিক্ষা পেলেন তবে কথায় নয় কাজে অনেকটা বুদ্ধিশীল ব্যক্তির ছলে বলে কৌশলে,,,কিন্তু অহমবোধ তাকে এতটাই পঙ্গু করে রেখে দিয়েছিল যে নিজেকে সংশোধনের পরিবর্তে উল্টে নালিশ জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে জব্দ করে তাকে শাস্তি দেবার জন্য))

বিদ্যাসাগরের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হলে তিনি উত্তরে যা লিখেছিলেন,,, তা অবিকল ইংরাজীতে উদ্ধৃতি করে দেওয়া হল,,,,

বিদ্যাসাগর লিখলেন,,,

" I thought that we(natives) were an uncivilized race quite unacquainted with refined manners of receiving a gentleman visitor.

I leagned the manners of which Mr. Kerr complains from the gentleman himself, a few days ago, when I had an occasion to call on him.

My notions of refined manners being thus formed from the conduct of an enlightened, civilised European,

 I behaved myself as respectfully him as he had himself done",,,,,


এখানে হিন্দিতে একটা কথা আছে,,,(("য্যায়সি করনি ওয়াসি ভরনি")),,,,,

(( এই লেখাটি অনুপ্রেরণা পেয়েছে একটি নাম না জানা সংগৃহীত কবিতা থেকে,,, তাকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ))

সুস্থ চৈতন্যশীল বোধোদয় পুরুষসিংহে বিদ্যাসাগর যার নাম,,,,
যার মস্তক হয়েছে খন্ডিত পাপাত্মার খান্ডবদহনে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের করালঘাতে,,,,
চূর্ণবিচূর্ণ লুন্ঠিত সেই পুণ্যাত্মা আজ ভূমির শয্যায়,,,
 প্রখর আত্মসম্মান হারিয়ে এক প্রকট অবমাননা ও লজ্জায়,,,,
এই ঘটনার সাক্ষ্য সকল অবরুদ্ধ বাঙালী চেতনায় জেগে উঠুক লজ্জা,,,এক ধিক্কারে সরব দীর্ঘশ্বাসে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ,,,, ছি ছি,,,,

কিন্তু নীরব বাঙালী সমাজ আজ নির্বাক ও নীরব পাথর হয়ে বাঁচে।
যতো ভন্ডামো ও চাটুকারিতায় তাদের মুখের উপর তুলে দেওয়া ক্ষমতার পাদুকা পদলেহন করে।
তখন হয়ত তাদের মরা বিবেক দর্পণে (গৃহশোভা) দেখে,,,সভ্যতা লজ্জায় কেমন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে,,, রোজ নগ্নতায় ধর্ষণকামী শরীর পোষাকের আচ্ছাদনে লুকিয়ে রেখে,,,,

বিদ্যাসাগরের পাষাণপ্রস্তরে এই আঘাত এসেছে কিন্তু তার উচ্চ আদর্শ ও উন্নত শির এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
 উগ্র অন্ধ বিষ যা সাম্প্রদায়িকতার নামে মানুষকে বিষাক্ত সোমরসের ঘোরে আসক্ত করে রেখেছে ---যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেই মূল্যবোধটুকু হারিয়ে ফেলেছে,,,,,,
প্রকৃত জ্ঞানের ও মনুষ্যত্বের আলো অপ্রচলিত সভ্যতার হ্যারিকেনে গচ্ছিত রেখে তাকে নিভিয়ে দিয়ে শুতে চলে গেছে কর্মবিমুখ প্রতিবাদের অন্ধকার বুকে চেপে প্রচন্ড ভয় পেয়ে।
প্রতিবাদের ভাষা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে,,,,

কিন্তু তারা হয়ত ভুলে গেছে দল, মত, ধর্ম, রাজনীতি সকল কিছু পরে আসে,,, আগে আসে মনুষ্যত্ব,,,,
মায়ের দুধের ঋণ যেমন অসমাপ্ত শোধে তোমার শিয়রে সদাজাগ্রত থাকে,,,, তোমাকে লালন করতে থাকে প্রতিক্ষণে নিজ মাতৃস্নেহস্নিগ্ধ পরশে,,,, ঠিক তেমনি,,,,
বাঙালীর প্রতি নিঃশ্বাসে মাতৃভাষার অমোঘ বিশ্বাসে প্রতিক্ষণে বিদ্যাসাগর জাগে,,,,,

জাগো বাঙালী জাগো,,,, আর কেন,,,, অনেক তো হলো,,,,