শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-৪ / রূপক সামন্ত

['যে করে আমার আশ
আমি করি তার সর্বনাশ
তবুও যে করে আমার আশ
আমি হই তার দাসানুদাস' ---প্রচলিত কীর্তন]

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বৈশাখ মাসের শুক্লা নবমী তিথির মাহেন্দ্রক্ষণে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। যথাসময়ে মন্দিরের কাজ শেষ হল। সমস্যা হল অন্য। জগন্নাথদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও উপযুক্ত ব্রাহ্মণের সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন দেবর্ষি নারদের আদেশে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মাকে এই মন্দির-প্রতিষ্ঠা মহাযজ্ঞের হোতা ব্রাহ্মণ পদে বরণ করার আবেদন নিয়ে স্বর্গে গেলেন। সেখানে ব্রহ্মাকে সব নিবেদন জানানোর পর তিনি রাজাকে অপেক্ষা করতে বললেন। ইতিমধ্যে বহু বৎসর কেটে গেছে। সমুদ্রের ধারে নির্মিত মন্দিরটি বালির তলায় চাপা পড়ে গেল। সে মন্দিরের খবর সবাই বিস্মৃত হল। উড়িষ্যার রাজা তখন সুরদেবপুত্র গলমাধব। একদিন সমুদ্রের তীর ধরে যাওয়ার সময় তিনি দেখলেন যে একটি ঘোড়া বালির উঁচু ঢিপিতে আটকে পড়েছে। কিছুতেই বার হয়ে আসতে পারছে না। রাজা গলমাধব গেলেন ঘোড়াটিকে উদ্ধার করতে। তিনি বুঝতে পারলেন যে ঘোড়ার পা বালির নীচে কোনও কিছুতে আটকা পড়েছে। রাজার নির্দেশে লোকজন সেই ঢিপির বালি সরিয়ে আবিষ্কার করল বালিচাপা সুন্দর এক মন্দির। রাজা সেই মন্দিরের শৈলী ও কারুকাজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কে তৈরি করল এত সুন্দর মন্দিরটি!!! কেনই বা মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়ে বালিচাপা পড়ে গেল!! এসব প্রশ্নের কোনও সমাধান হল না। লোকমুখে মন্দিরটি গলমাধবের মন্দির বলে প্রচলিত হল।

ইতিমধ্যে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে মর্ত্যে ফিরলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। সব দেখেশুনে তিনি গলমাধবের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে মন্দিরটি ফেরৎ চাইলেন। গলমাধব বললেন যে তিনি কোনও ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার নাম শোনেন নি। এই মন্দির তিনি নির্মাণ করিয়েছেন। কাজেই ফেরৎ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মার কাছে বিহিত চাইলেন। তখন ব্রহ্মা ধ্যানযোগে সবকিছু জেনে বিধান দিলেন-- “মন্দিরটি বালির মধ্যে থেকে বার করার জন্য গলমাধবের প্রাপ্য আছে। তবে মিথ্যা বলার জন্য ওর নাম সবাই ভুলে যাবে। কেউ মনে রাখবে না গলমাধবের কথা।” তাইই হল। রাজা গলমাধবের কথা লোকের মন থেকে হারিয়ে গেল। পুনরায় রাজা হলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন।

দুই রাণীর গর্ভে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আঠারোটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। এছাড়াও ত্রিলোকিনী নামক বড়রাণীর এক সহচরীর গর্ভে তনুদ্ভব নামক আর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করল। প্রধান রাণীদের আঠারো জন পুত্রই ছিল উচ্ছৃঙ্খল, দুর্বিনীত, অতিভোজী, অতিনিদ্রালু, মদমত্ত ও নারীবিলাসী। তারা জগন্নাথদেবের পূজা করত না। প্রত্যেকেই রাজা হওয়ার জন্য উদগ্রীব। তনুদ্ভব কিন্তু ছিল ধর্মপরায়ণ ও বিনীত। জগন্নাথদেবের প্রতি তার অচলা ভক্তি। একারণে রাজা তনুদ্ভবকে বিশেষ স্নেহ করতেন। একদিন রাজা সকল পুত্রদের নিয়ে জগন্নাথদেবের মন্দিরে গেলেন। মন্দিরের সিংহদ্বারের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় রাজা নীচে পড়ে গেলেন। তনুদ্ভব ছাড়া আর কোনও পুত্র রাজার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো না। তখনই রাজা তনুদ্ভবকে পরবর্তী রাজা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আঠার পুত্র রাজার এই সংকল্পের কথা শুনে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধঘোষণা করল। তখন পিতার আশীর্বাদে তনুদ্ভব ওই আঠারো জন রাজপুত্রকে পরাজিত করে ক্ষতবিক্ষত করে আহত করল। এইবার আহত মরণাপন্ন রাজপুত্রগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে জগন্নাথপদে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগল। জগন্নাথদেব তাদের শ্রীক্ষেত্রের নিকট আঠারোটি নালার রূপ ধরে অবস্থান করতে বললেন। সাধুগণ যখন ওই আঠারো নালা পেরিয়ে শ্রীক্ষেত্রে যাবেন তখন তাঁদের পদরেণুস্পর্শে ধীরে ধীরে তাদের পাপক্ষয় হবে। এই দৈববাণী শোনার পর আঠারো জন রাজপুত্র প্রাণত্যাগ করলেন।


জগন্নাথদেব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে দৈববাণীতে জানালেন-- তোমার দাসীপুত্র তনুদ্ভবকে রাজা করো। চল্লিশ বছর রাজত্ব করার পর তার মৃত্যু হবে। তখন তুমি নরেন্দ্রপুত্র গাল'এর হাতে রাজ্যভার দিয়ে ব্রহ্মলোকে গমণ করবে। এখন তুমি পুত্রদের সৎকারের ব্যবস্থা কর। শ্রীক্ষেত্রের বাইরে সারি সারি আঠারোটি নালা কেটে তাদের উপর আঠারোটি চন্দনকাঠের চিতা প্রস্তুত করবে। সেইসব চিতার উপর তোমার আঠারো জন সন্তানকে শুইয়ে দাহকার্য করবে। এই আঠারোটি নালার উপর দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা করবে। সেই পথের উপর সাধুজনের পদরজ পড়লে তোমার পুত্রদের সদগতি হবে। তুমি নিজে পরম বৈষ্ণব। তোমরা পুত্ররা বৈষ্ণব-আত্মজ। সেইহেতু যারা তোমার পুত্রদের চিতাভস্ম স্পর্শ করবে তারা মহাপাপী হলেও তাদের সকল পাপ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। তারা অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ করবে।

এই নির্দেশ অনুযায়ী রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আঠারোটি নালা কেটে তার উপর পুত্রদের সৎকার করলেন। আজও জগন্নাথমন্দিরের উত্তরদিকে এই আঠারো টি নালা অতি পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়। আজও সাধুসন্তরা এই আঠারো নালার উপর দিয়েই জগন্নাথমন্দিরে আসেন।


তনুদ্ভব রাজা হওয়ার পর দুই রাজরাণীই গত হলেন। তখন রাজা তপস্যায় মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলে মার্কন্ডেয়মুনি রাজাকে বললেন- তোমার কোথাও তপস্যা করতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার কোনও যাগযজ্ঞ বা তপস্যার প্রয়োজন নেই। এই নীলাচল হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ। তুমি এখানেই প্রভু জগন্নাথের সেবা করে যাও।--রাজা নীলাচলেই প্রভুর সেবা ও ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে রইলেন।


অনেক বছর এমনইভাবে কেটে গেলো। একদিন জগন্নাথদেব রাজাকে দেখা দিয়ে বললেন-- তোমার কাজ পূর্ণ হয়েছে। ভগবান ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে গমণের জন্য রথ পাঠাচ্ছেন। সেখান থেকে বৈকুণ্ঠে এসে আমার সান্নিধ্য লাভ করে মোক্ষপ্রাপ্ত হবে। আজ থেকে তোমার কোনও বংশই থাকবে না। আজ মধ্যাহ্নে তনুদ্ভবকে আমার কাছে প্রেরণ করবে আর নরেন্দ্রপুত্র গলমাধবকে রাজ্যের ভার অর্পণ করবে।

রাজা নির্দেশমত তনুদ্ভবকে মন্দিরে পাঠালেন। তনুদ্ভব মন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথকে দর্শন করতেই তার গোটা শরীরটা গরুড়স্তম্ভে লীন হয়ে গেল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের নির্বংশ হওয়ার প্রার্থনা পূরণ হল। এই ঘটনার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গলমাধবের হাতে রাজ্যভার দিয়ে জগন্নাথসেবার সমস্ত বিষয় সবিস্তারে বুঝিয়ে দিলেন।  তারপরই দেখতে পেলেন ব্রহ্মাপ্রেরিত পুষ্পরথ শূন্যে অপেক্ষা করছে। রাজা বুঝতে পারলেন যে তাঁর দেহ রাখার সময় হয়েছে। তিনি কালক্ষেপ না করে শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথের মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে প্রাণবায়ু শরীর ত্যাগ করে গেল। তাঁর পবিত্র আত্মাকে পুষ্পরথে চাপিয়ে নিয়ে দেবসারথী ব্রহ্মলোকে গমণ করলেন। রাজা গলমাধব বহু বৈষ্ণব সমাহারে, নামসংকীর্তন সহযোগে, ইন্দ্রদ্যুম্নের মরদেহ পঞ্চতীর্থের জলে স্নান করিয়ে বিধিমত অগ্নিসৎকার করলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূতঃদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেও পৌরাণিক কাহিনীতে অমর হয়ে রয়ে গেলো তাঁর কীর্তি।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন