শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-৫ / রূপক সামন্ত

[নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে। বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ।
পরমাত্মা স্বরূপ যাঁরা নিত্যকাল নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলদেব, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেবকে প্রণতি নিবেদন করি।]

আজ থেকে প্রায় ঊনচল্লিশ বছর আগে বাবার হাত ধরে, তারকেশ্বর থেকে বড় একটা দলের সাথে, প্রথমবার পুরী গেছিলাম। সেবার জগন্নাথ মন্দিরের উল্টোদিকে একটি ধর্মশালায় সাতদিন ছিলাম। বাবা, প্রয়াত ডঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত ছিলেন পন্ডিত গবেষক মানুষ। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে সেই জায়গাটি সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তারপর ঠিক করে নিতেন কোন কোন বিষয়গুলি গভীর মনোনিবেশ সহকারে দেখবেন। তাঁর ঝোলায় খাতা ও কলম থাকত। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি তাতে লিখে নিতেন। তারপর ফিরে এসে সে সম্পর্কে আরও পড়াশোনা করতেন ও লিখতেন। পুরীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। এর আগেও একবার ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে তিনি পুরীতে মাসখানেক ছিলেন। ফলে পুরী তাঁর কাছে তখনই অনেকটা চেনা জায়গা। সেবারে বাবাকে ভোর তিনটের সময় উঠে, স্নানাদি সেরে, জগন্নাথদেবের বিশেষ অঙ্গসজ্জা দেখার জন্য মন্দিরে যেতে দেখেছি। পুরীর জগন্নাথ মন্দির সম্পর্কে তিনি দুটি অনবদ্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রথমটি--'পুরীর মন্দিরের দেওয়াল চিত্রণ', ১৯৮০-৮১ পাঠবৎসরের 'বাঁকুড়া খৃশ্চান কলেজ পত্রিকা'য় প্রকাশিত। দ্বিতীয়টি--'পুরীর মন্দিরের মূর্তকলা', ১৪০৫ সালের 'খেয়ালী' পত্রিকায় প্রকাশিত। পরবর্তীকালে প্রবন্ধদুটি তাঁর 'সংস্কৃতি ও শিল্পভাবনা' বইতে গ্রন্থিত হয়েছে [ প্রকাশক-সাহিত্য প্রকাশ, ৬০ জেমস লঙ সরণি, কলকাতা-৩৪, প্রথম প্রকাশ-৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪, পরিবেশক-পুস্তক বিপণি, ২৭ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা-৯]। পুরী ও জগন্নাথ সম্পর্কে অজস্র গ্রন্থ, প্রবন্ধাদি লেখা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমি কিন্তু স্বল্প পড়াশোনায় জগন্নাথ মন্দিরের ও সংলগ্ন অন্যান্য মন্দিরের দেওয়াল চিত্রণ নিয়ে কোনও আলোচনা কোথাও দেখিনি বা শুনিনি। প্রথম প্রবন্ধটি এবিষয়ে একেবারেই নতুন একটি দিকনির্দেশ। প্রসঙ্গতঃ জানাই যে এই দেওয়াল চিত্রগুলি এঁকেছেন পুরী থেকে ১২ কিমি দূরে, ভার্গবী নদীর ধারে অবস্থিত রঘুরাজপুর শিল্পগ্রামের শিল্পীরা। তাঁরাই প্রতিবছর রঙের প্রলেপ দিয়ে এই চিত্রগুলিকে উজ্জীবিত করেন। আমার জগন্নাথ সম্পর্কিত নিবেদনে এই প্রবন্ধদুটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। প্রভু জগন্নাথ সম্পর্কিত নিবেদনের মাঝে সেকারণে এই আত্মকথনটুকুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাঁর শ্রীচরণে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

পৌরাণিক এবং লোককাহিনীতে আমরা জেনেছি যে মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রথম জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর পরিচয় সম্পর্কে দু'টি মত প্রচলিত আছে। একটি মতে ৪৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পণ্ডুবংশের রাজা ছিলেন উদয়ন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইন্দ্রবল ই পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে কীর্তিত হন। আরেকটি মতানুসারে সূর্যবংশের রাজা রামচন্দ্রের দুই পুত্র কুশ ও লব এর মধ্যে কুশ এর বংশের ঊনিশতম উত্তরপুরুষ হলেন দেবলিক। এই দেবলিকের পুত্রই হলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। তখন কিন্তু নীলমাধবের পুজো হত। ইন্দ্রদ্যুম্নই জগন্নাথদেবের পুজো প্রচলন করেন। একটি কাহিনীসূত্র জানাচ্ছে যে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নে জগন্নাথদেবের সম্পূর্ণ রূপটি দর্শন করেছিলেন। রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্নও এই শ্রীক্ষেত্র দর্শন করেছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।



উড়িষ্যার মন্দিরস্থাপত্যরীতি অনুসারে জগন্নাথদেবের আধুনিক মন্দিরটি নির্মিত। এই দেবদেউল চারটি স্তরে বিন্যস্ত।  সবচেয়ে উঁচু পীঢ়াদেউলটি হল বিমান বা গর্ভগৃহ। এরমধ্যেই রত্নবেদীতে স্থাপিত আছেন বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথ ত্রয়ী দেবতাসহ মোট সাতটি বিগ্রহ। দেউলের পরবর্তী অংশটি হল জগমোহন, তার পরের স্তরটি নাটমন্ডপ এবং শেষ স্তরটির নাম ভোগমন্ডপ। নাটমন্ডপের দেওয়ালে, স্তম্ভগুলিতে, ছাদের সিলিংয়ে সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের অজস্র পৌরাণিক চিত্র অঙ্কিত আছে।


ডঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্তের প্রবন্ধে সেগুলি সম্পর্কে  আলোচনা আছে। এগুলির মধ্যে সিলিংএ, ত্রিকোণাকৃতি ক্ষেত্রে অঙ্কিত দুটি বিশেষ জগন্নাথ চিত্রের কথা বিশদে লিখেছেন তিনি। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী 'গরুড়স্তম্ভের মাথার উপর অংশে বাঁকানো সিলিংএ ছবিটি আঁকা হয়েছে। ছবিটি পশ্চিমমুখী।  অর্থাৎ মন্দির অভ্যন্তরে বেদীর ওপর রক্ষিত দারুব্রহ্মের দিকে মুখ করে আছে। বেদীর ওপর রক্ষিত দারুমূর্তি ত্রয়ের মধ্যে প্রধান বলরাম ও জগন্নাথ, সুভদ্রার মূর্তি তুলনামূলকভাবে ছোট। বলরাম ও জগন্নাথের দারুমূর্তি দ্বিবাহু সমন্বিত এবং উচ্চতায় অবয়বে প্রায় সমান। দারু জগন্নাথ স্থূল নাসা ও স্ফীতোদর। কিন্তু সিলিংয়ের ত্রিভুজ এ ছবিটিতে জগন্নাথের প্রাধান্য। জগন্নাথ এখানে চতুর্ভুজ। উপবিষ্ট মূর্তি। তাঁর কোলে সুভদ্রা ও তাঁর মাথার পিছনে বলরাম। উভয়েই বসে আছেন। আঁকা ছবির জগন্নাথের নীলাঞ্জন গাত্রবর্ণ  চোখ জুড়িয়ে দেয়। তাঁর মুখাবয়ব, তাঁর চতুর্ভুজ সংস্থান, তাঁর উপবেশন ভঙ্গি নিখুঁত সুন্দর। এই মূর্তিচিত্রণ ঘটেছিল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্বপ্নে দেখা জগন্নাথের মূর্তি অনুযায়ী। ঐ ত্রিভুজ চিত্রের তিনটি ভুজই প্রায় ৫ ফুট দীর্ঘ। এই চিত্রটির মুখোমুখি বিপরীত দিকের ঢালু সিলিংয়ে আর একটি স্বপ্নদৃষ্ট জগন্নাথের চিত্রমূর্তি অঙ্কিত হয়েছে। এটিও ৫ ফুট বাহুর একটি পটচিত্রণ। চিত্রটি পুবমুখী। চিত্রটিতে সামান্য হলেও ভীষণতার বিভাব বর্তমান। এখানে জগন্নাথের মুখ নৃসিংহ অবতারের সিংহমুখের মতো। এখানেও জগন্নাথ চতুর্ভুজ এবং উপবিষ্ট, কোলে উপবিষ্ট সুভদ্রা। জগন্নাথের মাথার পিছনে বলরাম। বলরামের মাথায় সর্পছত্রফণা।' নাটমন্দিরের দেওয়ালচিত্রগুলি দেখতে দেখতে তাঁর সঠিক উপলব্ধি-'সহজেই বোঝা যায়, যেভাবেই হোক, বলরাম-সুভদ্রা-জগন্নাথের চিত্র অঙ্কনের জন্যই শ্রেষ্ঠতম শিল্পী-প্রতিভা নিয়োগ করা হয়েছিল। বর্ণবিন্যাস, অলঙ্করণ, অবয়ব সংস্থান প্রভৃতির দিকে নজর দিলে অনুভব করা যায় চিত্রশিল্পীর ভক্তি ও ভালোবাসা, সাধনা ও সিদ্ধির নিবিড়তা।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন