শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত

জয় জগন্নাথ-২ / রূপক সামন্ত

পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণ তীরবিদ্ধ করল যে জরা ব্যাধ, কে সে? কী তার পরিচয়!! ঘটনাটি ঘটেছিল পশ্চিমভারতের প্রভাস তীর্থে। তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স একশ সাত বছর। ক্ষমা করো প্রভু, আমার কূ'মন বলছে কোনও ব্যাধই তীর চালনা করেনি শ্রীকৃষ্ণকে লক্ষ্য করে। শ্রীকৃষ্ণ জরাগ্রস্ত হয়ে কালের স্বাভাবিক নিয়মেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একই কারণে সমবয়সী অর্জুনও গাণ্ডীব উত্তোলনের ক্ষমতা হারিয়েছেন। যদুবংশের রমণীদের দস্যুরা লাঞ্ছনা করছে এদৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরকে। এটাই আসল বাস্তবসম্মত কারণ। দেহপট সনে নট সকলি হারায়--আর শ্রীকৃষ্ণ তো স্বয়ং নটশ্রেষ্ঠ রসিক নটবরচন্দ্র। পুরাণ কিন্তু বলছে অন্য কথা। দ্বাপরের মহাভারতের সময়ে এই ঘটনা যে ঘটবে তার বীজ বপন হয়েছে আগের ত্রেতাযুগে। সেইযুগে বিষ্ণুর অবতার হলেন নবদূর্বাদলশ্যাম শ্রীরামচন্দ্র আর লক্ষ্মীদেবী সীতারূপে জন্মগ্রহণ করেছেন।


বনবাসকালে সীতাকে অপহরণ করেছেন লঙ্কারাজ রাবণ। সীতা উদ্ধারের জন্য সহায়সম্বলহীন রামচন্দ্র বন্ধুত্বের হাত মিলিয়েছেন আত্মগোপনকারী বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে। বন্ধুত্বের শর্ত পালন করতে গিয়ে রামচন্দ্র অন্যায়ভাবে সুগ্রীবঅগ্রজ বানররাজ মহাবলী বালীকে বধ করলেন। রামের কাছে বালীর কোনও অপরাধ ছিল না। তবুও সুগ্রীবের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় বালীকে পিছন থেকে লুকিয়ে হত্যা করলেন অবতার রামচন্দ্র। এ কেমন লীলাখেলা!! তোমার মহিমা তুমিই জানো প্রভু!! আমি হীনবুদ্ধি, সাধ্য কী সে মহিমা হৃদয়ঙ্গম করি! তা বালী বধের পর নিষ্কণ্টক রাজা হলেন সুগ্রীব। আর যুবরাজ হলেন বালীপুত্র মহাশক্তিধর অঙ্গদ। নাহ, অঙ্গদ কোথাও বালীহত্যা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেন নি। তাঁর মা রূপসীশ্রেষ্ঠা বিদূষী তারা যে নিজ পিতৃব্যের অঙ্কশায়িনী হলেন তা নিয়েও কোনও বক্তব্য অঙ্গদের মুখে রাখেন নি মহাকবি বাল্মিকী ও অন্যান্য রামায়নকারগণ। অঙ্গদের তৎকালীন মনের অবস্থার কোনও সংবাদ রামায়নে নেই। উপরন্তু লঙ্কাযুদ্ধে  রামচন্দ্রের অতিবিশ্বস্ত সেনাপতি হলেন অঙ্গদ। যুদ্ধশেষে সীতা উদ্ধারের পর রামচন্দ্র অঙ্গদকে বর চাইতে বললেন। জানেন কী বর চেয়েছিলেন অঙ্গদ সেদিন!! পিতৃহত্যার পুঞ্জিত রাগ, ক্ষোভ, বেদনা আর বাধা মানলো না।  বর চাইলেন- প্রভু, আমি যেন আমার পিতৃঘাতককে শাস্তি দিতে পারি। সাবাশ অঙ্গদ!! আর কোন বর চাইবার থাকতে পারে পিতৃহত্যাকারীর কাছে!!
রামচন্দ্র মৃদু হেসে বলেছিলেন-তথাস্তু। তোমার আশা পূর্ণ অবশ্যই হবে অঙ্গদ, ভক্ত আমার। -- দ্বাপরে শ্রীরামচন্দ্র হলেন শ্রীকৃষ্ণ, আর অঙ্গদ জরা ব্যাধ পরিচয়ে জন্ম নিলেন। শ্রীকৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিলেন তিনি।

জরা ব্যাধ সম্পর্কিত একটি অন্য কাহিনীও আছে। সেটি নিবেদন করি। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের নশ্বর মরদেহ পঞ্চপাণ্ডব পশ্চিমভারতের প্রভাসতীর্থে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন। এই প্রভাসতীর্থ আরবসাগরের তীরে অবস্থিত। আবরসাগরের জলে ভাসতে ভাসতে পুরুষোত্তমের দেহ এলো দক্ষিণভারতের ভারত মহাসাগরে। তারপর বঙ্গোপসাগরের জলে ভেসে ভেসে কতদিনে এসে উপস্থিত হল কলিঙ্গদেশে। ততদিনে নীলকান্তমণিসদৃশ গোপীবল্লভ কৃষ্ণতনু অত্যুজ্জ্বল এক নীল পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই দেবপ্রস্তরটি এসে উপস্থিত হল আজকের শ্রীক্ষেত্র পুরীতে। পাথর জলে ভেসে এল কীকরে!!! হয় হয়, তাঁর মহিমায় সবই হয়। বিশ্বাসে জলে ভাসে শিলা। ত্রেতায় যদি রামেশ্বরমে সমুদ্রজলে শিলা ভাসিয়ে সেতুবন্ধ তৈরি করা যায়, তবে দ্বাপরেই বা হবে না কেন! তখন ওইস্থানে সমুদ্রের ধারে গহীন বনে শবর জনজাতির বাস ছিল। শবররাজ জরা এই নীল পাথরটিকে সমুদ্রজলে ভাসন্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন। সযত্নে তুলে এনে গোপনে স্থাপন করলেন রোহিণীকুণ্ডের তীরে। তৎকালীন ঘন জঙ্গলাকীর্ণ রোহিণীকুণ্ডের অবস্থান বর্তমানের জগন্নাথ মন্দিরের পিছনদিকে। এককালের বিশাল সরোবর আজ ছোট একটি চৌবাচ্চায় পরিণত হয়েছে। তবু আজও এর জল অতি পবিত্র মানা হয়। শবররাজ জরা অতি গোপনে প্রত্যহ যথোবিধ ভক্তিসহকারে এই নীল পাথরটির পূজা করতে লাগলেন। ইনিই হলেন 'নীলমাধব'।

তখন কলিঙ্গের রাজা ছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি ঈশ্বরদর্শনের মানসে অতি কঠিন তপস্যা শুরু করলেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁকে স্বপ্নাদেশে পরমেশ্বর নীলমাধবের কথা জানালেন। অনেক সন্ধান করেও রাজা কিন্তু নীলমাধবের অবস্থান জানতে পারলেন না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে বিদ্যাপতি নামক এক তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্রাহ্মণকে রাজা এই দায়িত্ব দিলেন। বিদ্যাপতি ছলে-কৌশলে রোহিণীকুণ্ডের তীরে নীলমাধবের অবস্থান জেনে রাজাকে সংবাদ দিলেন। রাজা সদলবলে রেহিণীকুণ্ডে এসে নীলমাধব দর্শনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর চিত্তে নীলমাধবকে দেউলে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করার সাধ জাগলো। সসম্মানে ভক্তিভরে নীলমাধবকে নিয়ে ফিরে চললেন তিনি। তখন কি শবররাজ জরা কোনও বাধা দেন নি! তাঁর যে প্রাণপ্রিয় আরাধ্য দেবতা ওই নীলমাধব। হয়ত দিয়েছিলেন, হয়ত প্রবল রাজশক্তির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি!! আমি মূর্খজন, জানিনা জানিনা সেসব কথা।


রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কিন্তু নীলমাধবকে নিয়ে রাজধানীতে যেতে পারলেন না। পথিমধ্যে নীলমাধব সহসা অন্তর্ধান করলেন। ভগ্নহৃদয় রাজার কান্নায় পরমেশ্বরের হৃদয় বিগলিত হল। দৈববাণী হল-- রাজা, তুমি অতি প্রত্যুষে সমুদ্রস্নান সেরে শুদ্ধচিত্তে তটে অপেক্ষা করবে। দেববিগ্রহ নির্মাণের উপকরণ আসবে তোমার কাছে। -- সেই নির্দেশমত পরদিন রাজা সমুদ্রস্নান সেরে সমুদ্র
তটে প্রতীক্ষায় রইলেন। সমুদ্রের জলে ভেসে এল শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম চিহ্নশোভিত দারুখণ্ড। মহানন্দে রাজা পূজাপাঠ করে সেই দেব-দারুকে রাজপুরীতে নিয়ে এলেন। সমস্যা দেখা দিল অন্য। কে তৈরি করবে দেববিগ্রহ!! কোনও তক্ষণশিল্পীর অস্ত্রাঘাতে সেই দারুখণ্ডে বিন্দুমাত্র দাগ পড়ল না। এখন উপায়!! মাথায় হাত দিয়ে বসলেন রাজা। স্নানাহার বন্ধ হল তাঁর। অগত্যা শরণাগতি। একাগ্র প্রার্থনা-- হে প্রভু, তুমিই এর উপায় করে দাও। তখন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা বৃদ্ধ তক্ষণশিল্পী 'অনন্ত মহারাণা' নাম নিয়ে এলেন রাজদরবারে। শর্ত দিলেন বদ্ধঘরে একুশদিনে তিনটি মূর্তি তৈরি করবেন তিনি। ওইসময় কোনওমতেই ঘরের দরজা খোলা চলবে না। শিল্পীকেও ডাকা চলবে না। দেবমূর্তি তিনটির রূপ তিনি ওইসময়েই তপস্যায় জেনে নেবেন। নিরুপায় রাজা মেনে নিলেন সব শর্ত। অনন্ত মহারাণা ওই দেব-দারুর যথাবিহিত পূজান্তে কর্মশালার ঘরের বেদীতে স্থাপন করে তাঁর যন্ত্রপাতিসমেত ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। রাজাদেশে বাইরে থেকে ঘরের দরজায় পড়ল তালা, আর তালার উপর সীলমোহর। রক্ষী নিযুক্ত হল দ্বারে। রাজ্যশুদ্ধু লোক বাইরে রইলেন শবরীর প্রতীক্ষায়।

একদিন গেল, দুদিন গেল--- সকলের উদগ্রীব প্রতীক্ষা সন্দেহে পরিণত হল। আদৌ বন্ধঘরে কিছু হচ্ছে তো!! কোনও শব্দ তো ভেসে আসছে না বাইরে! ভিতরে যে কেউ আছে, কোনও মূর্তি যে তৈরি হচ্ছে তার কোনও লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। এদিকে মূর্তিপ্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ এগিয়ে আসছে। আয়োজনও প্রায় সমাপ্ত। সবাই উদ্বিগ্ন, রাজা নিজেও বিভ্রান্ত। তথাপি শর্ত লঙ্ঘন করলেন না তিনি। পনেরদিনের মাথায় বেঁকে বসলেন পাটরাণী গুণ্ডিচা। রাজাকে বললেন - মহারাজ, মনে হচ্ছে ওই শিল্পী আপনাকে প্রতারণা করেছে। আপনি দ্বার উন্মুক্ত করুন। রাজা রাজী হলেন না। তখন মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করলেন মহারাণী। বললেন-বেশ, আমিও তাহলে আমার ঘরে খিল দিচ্ছি। আজ রাত্রির মধ্যে আপনি যদি কর্মশালার দ্বার উন্মুক্ত না করেন, তবে আগামীকাল প্রত্যুষে আমি আত্মহত্যা করব। এই বলে সত্যিসত্যিই মহারাণী তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করে আগল দিলেন। মহারাজা পড়লেন বিষম ফাঁপরে। শর্ত রাখি, নাকি রাণীকে রাখি!! যুগে যুগে রমণীর অভিমানের কাছে পুরুষ বড় অসহায়। বাধ্য হয়ে মহারাজ কর্মশালার দ্বার উন্মুক্ত করার আদেশ দিলেন। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলেন কেউ নেই সেখানে। বৃদ্ধ শিল্পী অন্তর্হিত হয়েছেন। পড়ে আছে অসম্পূর্ণ হস্তপদবিশিষ্ট অসমাপ্ত তিন বিগ্রহ। দুটি দেববিগ্রহ-- জগন্নাথ আর বলভদ্র। একটি দেবীবিগ্রহ-সুভদ্রা। কী আর করেন রাজা!! মনের দুঃখে অসমাপ্ত বিগ্রহত্রয়ীকেই প্রতিষ্ঠা করার আদেশ দিলেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন