শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-৩ / রূপক সামন্ত


প্রভু জগন্নাথকে কেন্দ্র করে যে সুপ্রাচীন সংস্কৃতির ধারা আজও সবেগে বহমান, তার প্রাণবিন্দু হলেন নীলমাধব। নীলমাধব সম্পর্কিত প্রচলিত কাহিনীগুলির মধ্যে ঘটনাপরম্পরার সাযুজ্য থাকলেও কাহিনী, স্থান ও পাত্রের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন আর একটি কাহিনীতে বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণের মৃতদেহ সমুদ্রজলে ভাসতে ভাসতে ইন্দ্রনীলা পাথরে, মতান্তরে নীলাভ দারুখণ্ডে পরিণত হয়েছিল। এই ইন্দ্রনীলা পাথর এসে পৌঁছুলো উড়িষ্যারাজ্যের মহানদীর তীরে। বর্তমানে নয়াগড় জেলার খণ্ডপাড়া ব্লকের কান্তিলো নামক জায়গায়। জায়গাটি ভুবনেশ্বর থেকে ৭৩ কিমি দূরে অবস্থিত। এটি উড়িষ্যার মহানদী, কুসমী ও কুঁড়িয়া (kaunria) নদীর ত্রিবেণীসঙ্গম। দুটি পাহাড়ের মাঝে জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে তখন শবর জনজাতির বাস ছিল। শবররাজ বিশ্বাবসু এই ইন্দ্রনীলাকে নিয়ে এসে এক গুহায় অত্যন্ত গোপনে স্থাপন করে নিত্যপুজো করতেন। এখনও এখানে অতিপ্রাচীন নীলমাধবের মন্দির আছে। মন্দিরটির আকৃতি জগন্নাথ মন্দিরের ন্যায়। নীলমাধবের পাদপদ্ম থেকে নির্গত হয়েছে অবিরাম পুণ্য জলধারা। আর আছেন সিদ্ধেশ্বরনাথ। এখানে রথ সপ্তমীর উৎসব খুবই বিখ্যাত। মাঘ মাসের একাদশী তিথিতে এখানে মেলা বসে। পৌষপূর্ণিমায় হয় বিশেষ উৎসব। সেদিন নীলমাধব স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত হয়ে ভক্তদের দর্শন দেন।

সেইসময় মালবদেশের রাজা ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন মালবদেশের রাজা। অবন্তীনগরে তাঁর রাজধানী। একদিন এক সন্ন্যাসী এসে রাজাকে পুরুষোত্তমপুরের নীলপর্বতে নীলমাধবের মাহাত্ম্য জানালেন। বললেন- নীলমাধব মুক্তিপ্রদায়ক। তাঁর পূজায় মোক্ষলাভ হয়।--রাজার হৃদয়ে নীলমাধব দর্শনের ইচ্ছা প্রবলতর হল। তিনি রাজপুরোহিতের ভ্রাতা বিদ্যাপতির উপর নীলমাধবের সন্ধানের দায়িত্ব দিলেন। বিদ্যাপতি নানাভাবে অণ্বেষণ করে শবররাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ রাখালরাজ নন্দদুলালের রূপ ধরে বিদ্যাপতিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। শবররাজ বিশ্বাবসু সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদ্যাপতিকে গৃহে স্থান দিলেন। অতিথিসেবার ভার অর্পিত হল সদ্যযৌবনা রাজকন্যা ললিতার উপর। বিদ্যাপতি ছিলেন বিবাহিত। তথাপি বিদ্যাপতি ও ললিতা পরস্পরের প্রেমে পড়লেন। ফলস্বরূপ ললিতা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন। তিনি  বিদ্যাপতিকে বিবাহ করার জন্য অনুরোধ করলেন।


বিদ্যাপতি রাজী হলেন একটি শর্তে--নীলমাধবের দর্শনলাভ। শুনে চমকে উঠলেন ললিতা। তা কী করে সম্ভব!! এই কথা যে অত্যন্ত গোপনীয়। পিতা বিশ্বাবসু আর ললিতা ছাড়া আর কারও তা জানার কথা নয়। এই বিদেশী কিভাবে জানলেন এই অতিগূহ্য কথা!! খুবই চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন ললিতা। গর্ভস্থ সন্তানের পরিচয়ের প্রশ্নে অবশেষে মাতৃত্ব জয়ী হল। বিদ্যাপতির চোখ বেঁধে নানা ঘুরপথে নিয়ে গেলেন নীলমাধব দর্শনে। বুদ্ধিমান বিদ্যাপতি ললিতার অলক্ষ্যে সারা পথে সরিষাদানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। নীলমাধব দর্শনে মোহিত হলেন বিদ্যাপতি। মনে বাসনা হল যে নীলমাধবকে রাজধানীতে নিয়ে যাবেন। কিছুদিন পর বিদ্যাপতি-ললিতার এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। তখন বিদ্যাপতি রাজধানীতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। নীলমাধবকে নিয়ে যাওয়ার বাসনায় সরিষাগাছের চিহ্ন ধরে নীলপর্বতের গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন। এদিকে অন্তর্যামী নীলমাধব বিদ্যাপতির মনোভাব জেনে অন্তর্ধান করলেন। অন্যমতে বিশ্বাবসুই ললিতার নিকট সব জেনে নীলমাধব দর্শনে নিয়ে যান। তিনিই বিদ্যাপতির মনোভাব বুঝতে পেরে নীলমাধবকে গোপন করেন। যাইহোক বিদ্যাপতি ফিরে এসে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে সবকিছু নিবেদন করলেন। রাজা সৈন্যসামন্ত নিয়ে নীলমাধবকে আনার জন্য নীলপর্বতে উপস্থিত হলেন। নীলমাধব অন্তর্হিত হয়েছেন শুনে রাজা নিতান্ত ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন। অনশনে প্রাণত্যাগ করার জন্য কুশশয্যায় শয়ন করলেন। তখন দেবর্ষি নারদ দৈববাণীতে বললেন- হে রাজন। তোমার প্রাণত্যাগের প্রয়োজন নেই। এইস্থানে জগন্নাথদেব তোমার মাধ্যমে দারুব্রহ্মরূপে পূজা পাবেন। স্বয়ং পিতা ব্রহ্মা একথা বলেছেন।---একথায় উজ্জীবিত হয়ে রাজা অন্নগ্রহণ করলেন।

এরপর একরাতে শ্রীবিষ্ণু স্বপ্নাদেশে জানালেন-- তুমি আমার প্রিয় ভক্ত। আমি ভক্তের কাছ থেকে কদাপি দূর হই না। আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্মরূপে পাবে।।

দৈবনির্দেশ অনুযায়ী রাজা স্নানাদি তর্পণ সেরে শুদ্ধচিত্তে সমুদ্রতটে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। জায়গাটি হল বর্তমানের চক্রতীর্থ, শ্রীক্ষেত্র পরিক্রমার অতি পুণ্যস্থান।  যথাসময়ে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চিহ্নশোভিত বিশাল একখন্ড কাঠ ভেসে এল সেখানে। রাজা পরমানন্দিত হলেন। ভক্তগণ নামকীর্তন করতে লাগলেন। রাজা ওই কাঠটিকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার উদ্যোগ করলেন। কাঠটিকে কিন্তু একচুলও নড়ানো সম্ভব হল না। এমনকি অনেকগুলি হাতি দিয়ে টেনেও নড়ানো সম্ভব হল না। রাজা হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। তখন দৈববাণী হল-- শবররাজ বিশ্বাবসু আমার পরম ভক্ত। তাকে পরম সমাদরে আনার ব্যবস্থা করো। আর একটি স্বর্ণরথ আনয়ন কর। -- রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, রাজা বিশ্বাবসু ও বিদ্যাপতির সহায়তায় সেই কাঠটিকে সোনার রথে চাপিয়ে নামসঙ্কীর্তন করতে করতে রাজধানীতে নিয়ে এলেন। পাটরাণী গুন্ডিচার আবাসস্থল গুন্ডিচাবাটিতে শাস্ত্রসম্মত কর্মশালার মহাবেদী নির্মিত হল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল। এবার মূর্তি তৈরির পালা। এরপরের কাহিনী সবই আগের মত।

বিশ্বকর্মা, মতান্তরে স্বয়ং জগন্নাথদেব অনন্ত মহারাণার রূপ ধরে এসে শর্তসাপেক্ষে বদ্ধ কর্মশালায় একুশদিনে মূর্তি তৈরিতে রাজী হলেন। তিনি রাজাকে আরও বললেন- যে সমস্ত তক্ষণশিল্পী মূর্তি তৈরি করতে এসে বিফল হয়েছেন, তাঁদের দিয়ে তিনটি অত্যুত্তম রথ প্রস্তুত করান। --সেইমত ব্যবস্থা হল। অনন্ত মহারাণা কর্মশালায় প্রবেশের পর দ্বার বন্ধ করে প্রহরী নিয়োগ করা হল।

মহারাণী গুণ্ডিচা কিন্তু কৌতুহল দমন করতে পারলেন না। শ্রীবিষ্ণুর দারুরূপ দর্শনের মানসে চৌদ্দদিনে, মতান্তরে নয়দিনে, কর্মশালার দ্বার উন্মুক্ত করে দেখলেন -- তিনটি অসম্পূর্ণ বিগ্রহ। আর শিল্পী অন্তর্হিত হয়েছেন। --- একী মূর্তি শ্রীবিষ্ণুর!!! দেহের ঘন কৃষ্ণ বর্ণ, গোলাকার চক্ষুদ্বয়, হস্তপদহীন---এই অপ-রূপ দর্শনে রাণী মূর্চ্ছা গেলেন। সংবাদ পেয়ে রাজা এসে রাণীকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলেন। এখন তবে উপায়!! অসম্পূর্ণ বিগ্রহ কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে!! কোনও শাস্ত্র এ অনুমোদন দেবে না। --দুশ্চিন্তায় ভগ্নমনোরথ রাজার দুচোখ জলে ভেসে গেল। তখন ভগবান বিষ্ণু আবার স্বপ্ন দিলেন রাজাকে। বললেন --- “আমার ইচ্ছায় দেবশিল্পী মূর্তি নির্মাণ করতে এসেছিলেন। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ হওয়াতে এই রূপ মূর্তি গঠিত হয়েছে। হে রাজন, তুমি আমার পরম ভক্ত, আমি এই অসম্পূর্ণ মূর্তিতেই তোমার পূজা নেবো। আমি দারুব্রহ্মরূপে পুরুষোত্তমক্ষেত্রে নিত্য অবস্থান করবো। আমি প্রাকৃত হস্তপদ রহিত, কিন্তু অপ্রাকৃত হস্তপদাদির দ্বারা ভক্তের সেবাপূজা শ্রদ্ধা গ্রহণ করবো। আমি ত্রিভুবনে সর্বত্র বিচরণ করি। লীলা মাধুর্য প্রকাশের জন্য আমি এখানে এইরূপে অধিষ্ঠান করবো। শোনো নরেশ -- ভক্তেরা আমার এই রূপেই মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণ রূপের দর্শন পাবেন। যদি তুমি ইচ্ছা করো তবে ঐশ্বর্য দ্বারা সোনা রূপার হস্ত পদাদি নির্মিত করে আমার সেবা করতে পারো। ” সেই নির্দেশ অনুসারে উল্টোরথের পর একাদশীর দিন তিন বিগ্রহের সুবর্ণ-বেশ রথের উপর স্থাপন করা হয়। সেই বেশ দেখলে সাত জন্মের পাপ ক্ষয় হয়  বলে ভক্তজনের বিশ্বাস।


স্বপ্নেই রাজা জগন্নাথদেবের কাছে প্রার্থনা জানালেন যেন শিল্পী অনন্ত মহারাণার বংশধরগণ যুগ যুগ ধরে জগন্নাথের রথ নির্মাণের অধিকারী হয়। জগন্নাথদেব বললেন-তথাস্তু। তিনি রাজাকে আরও নির্দেশ দিলেন- শবররাজ বিশ্বাবসুর বংশধরগণ সেবক হবে। সেইথেকে আজও রথযাত্রার সময় শবররাই তিনবিগ্রহের বেশভূষা শৃঙ্গারাদি সেবা সমাপন করেন। জগন্নাথদেবের ইচ্ছায় বিদ্যাপতির প্রথমা স্ত্রী'র গর্ভস্থ সন্তানের বংশধরগণ হলেন জগন্নাথের পূজারী। আর ললিতা হলেন বিদ্যাপতির দয়িতা স্ত্রী অর্থাৎ প্রণয়িনী। তাঁর গর্ভের সন্তানের বংশধরগণ জগন্নাথের ভোগ প্রস্তুতের দায়িত্ব পেলেন। এঁরা দয়িতাপতি বা দৈতাপতি উপাধি লাভ করলেন।

যে বছর আষাঢ় মাসে বত্রিশ দিন হয়, সেই বছর জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা, সুদর্শন ও নীলমাধবের নবকলেবর উৎসব হয়। নবকলেবরের সময় এই দৈতাপতিরাই বিষ্ণুচিহ্নযুক্ত উপযুক্ত বৃক্ষের সন্ধান করেন। পূজাদি সমাপনান্তে সেই বৃক্ষগুলিকে ছেদন করে নিয়ে আসেন বৈকুণ্ঠ কোইলির কর্মশালায়। তারপর নবকলেবর প্রস্তুত হলে একান্ত গোপনে পুরোনো কলেবর থেকে নবকলেবরে জগন্নাথের ব্রহ্মস্থাপন করেন। পুরোনো কলেবরগুলিকে সমাধিস্থ করারও দায়িত্ব দৈতাপতিদের। দেখা গেছে যে নবকলেবরে ব্রহ্মস্থাপনের পর দৈতাপতি আর বেশিদিন বাঁচেন না। তাই এখন সবচেয়ে প্রাচীন দৈতাপতিই এই সেবা পালন করেন।

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জগন্নাথদেব স্বপ্নাদেশে তাঁর নিত্যপূজার আচারবিধি নির্দেশ করলেন। রাণী গুন্ডিচা এই অপরূপ বিষ্ণুকে সন্তানরূপে সেবার মানস করলেন। জগন্নাথদেব সে ইচ্ছাও পূরণ করলেন। সেই বর অনুযায়ী রথযাত্রার দিন থেকে মোট নয়দিন জগন্নাথদেব, বলভদ্র,সুভদ্রা ও সুদর্শন-গুন্ডিচার বাড়িতে সন্তানস্নেহে পালিত হন। গুণ্ডিচাবাটি হল জগন্নাথের মাসির বাড়ি।

সব নির্দেশ দেওয়ার পর জগন্নাথদেব ভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্নকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন- রাজন এবার তুমি বর চাও।-- রাজা পরমভক্ত। আর পরমভক্ত হবেন নিষ্কাম। রাজা এমনই ভক্ত যে তাঁর ইচ্ছায় জগন্নাথ এই অপরূপ মুরতি ধারণ করেন। তিনিও বড় কম নন। রাজা বিচিত্র এক বর চাইলেন। এমন বর আর কখনও কেউ চায় নি। রাজা প্রার্থনা করলেন--- প্রভু, আমাকে তুমি নির্বংশ করো। যাতে আমার কোনও বংশধর তোমার মন্দির ও তার সম্পত্তিতে অধিকার না ফলাতে পারে।---ধন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। নিষ্কাম সেবার প্রকৃত অধিকারী আপনিই। জগন্নাথদেব সেই বরও পূরণ করেছিলেন। অন্যসময় বলা যাবে সে কাহিনী। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথদেবকে কথা দিলেন-- সারাদিনে মাত্র একপ্রহর বা তিনঘন্টার জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকবে। বাকি সময় তা ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সারাদিন সবসময় আপনার সেবা ও ভোজন চলবে এখানে।--- মন্দির প্রতিষ্ঠা হল। পুরোহিত হলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন তিনিই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন