শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পুরাতনী ঐতিহ্যে জগন্নাথের রথযাত্রা,,,রূপক সামন্ত


জয় জগন্নাথ-১/ রূপক সামন্ত

বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় তীর্থক্ষেত্র ও পর্যটনস্থান হল উৎকল রাজ্যের পুরী। স্থানটির অনেক নাম। যতদূর দৃষ্টিসীমানা, ততদূর নীল অঞ্জন ঘন সমুদ্র - তাই এর নাম নীলাচল। পুরীর জগন্নাথ আদিতে ছিলেন নীলমাধব- সেকারণেই নীলাচল। জায়গাটির আকৃতি শঙ্খের ন্যায় এবং অজস্র সমুদ্র শঙ্খ পাওয়া যেত এখানে- তাই এটি শঙ্খক্ষেত্র। জগন্নাথ মন্দিরের স্থানটির কচ্ছপের পিঠের মত গড়ন- তাই এটি কূর্মক্ষেত্র। এছাড়া সবাইকার প্রিয় নাম হল পুরী। এছাড়াও পুরীর অন্য নামগুলি হল- পুরুষোত্তমধাম, উড্ডীয়ানপীঠ, মর্ত্যবৈকুণ্ঠ, উচ্ছিষ্টক্ষেত্র ইত্যাদি।

আচার্য শঙ্কর ভারতের চারদিকে চারটি প্রধান মঠ স্থাপন করলেন। বদরিকাশ্রম, দ্বারকাশ্রম, নীলাচলাশ্রম ও রামেশ্বরাশ্রম। পুরাণ মতে প্রভু জগন্নাথ উত্তরভারতের বদ্রীধামে স্নানাদি সেরে, পশ্চিমভারতের দ্বারকায় বেশভূষা ও প্রসাধন করে, পূর্বভারতের নীলাচলে অন্নগ্রহণ করে, দক্ষিণভারতের রামেশ্বরমে শয়ন করেন। পুরী নীলাচলে জগন্নাথ অন্নগ্রহণ করেন বলে এর অপর নাম অন্নক্ষেত্র। পুরীতে কেউ কখনও না খেয়ে থাকে না।

প্রভু জগন্নাথ জগতের নাথ। সবাই তাঁর সেবক। সবচেয়ে বড় সেবক হলেন স্বয়ং পুরীর রাজা। তিনি কেমন রাজা জানেন!! তিনি ঝাড়ুদার রাজা। জগন্নাথের রথযাত্রার সময় তিনি রথের পথ সোনার ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে যান। এমনটি আর কোথাও যে নেই।

জরা ব্যাধের বিষতির শ্রীকৃষ্ণের রাঙা চরণে এসে বিঁধলো। জরা হরিণ ভেবে তীর নিক্ষেপ করেছিল। ভুল বুঝতে পেরে লুটিয়ে পড়ল ওই রাঙা পায়ে-- প্রভু ক্ষমা করো। আমি মূর্খ ব্যাধ, না জেনে, ভুল করে তীর নিক্ষেপ করেছি। আমার এই অমার্জনীয় অপরাধ ক্ষমা করো প্রভু। ক্ষমা করেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী মহাভারতের প্রধান হোতা ও চালিকাশক্তি সারথী শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর কাজ শেষ হয়েছে। এবার তো যেতে হবে। মৃত্যুবরণ করলেন তিনি। দাদা বলরাম আগেই গেছেন।  সমগ্র যদুকূল আগেই নিঃশেষ হয়েছে। সব তিনি অসহায়ভাবে দেখেছেন। রোধ করতে পারেন নি। এটাই কী পরবর্তী অবতার ঠুঁটো জগন্নাথের আসার সঙ্কেত!! জানি না প্রভু। তোমার লীলা তুমিই জানো কেবল। আমি দীনজন দু'হাত তুলে বলি - জয় জগন্নাথ।

শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুসংবাদ গিয়ে পৌঁছলো হস্তিনাপুরের রাজা যুধিষ্ঠিরের দরবারে। রাজা যুধিষ্ঠির!! কেমন রাজা তিনি!! সর্বহারা রাজা, সব সবাইকে হারিয়েছেন কুরুক্ষেত্রের পুণ্য রণাঙ্গনে। শক্তিহীন রাজা তিনি। কেন বলছি জানেন! পাণ্ডবঅক্ষের প্রধান শক্তি অর্জুন তখন আর গাণ্ডীব তুলতে পারেন না। তিনি আর অজিত গান্ডীবী নন। সেই রাজা যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে ছুটে এলেন শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। ব্যথাভরা হৃদয়ে সৎকার্যের আয়োজন করলেন। সমুদ্রতীরে রচিত হল সুগন্ধী চন্দনকাঠের শয্যা। পারলৌকিক শাস্ত্রাচার মেনে শ্রীকৃষ্ণের, প্রিয় সুহৃদ ও প্রিয় ভ্রাতার ঘৃতচর্চিত নশ্বর দেহ শোয়ানো হল সেই শয্যায়। সুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের সাথে মুখাগ্নি করলেন যুধিষ্ঠির। হায় প্রভু!! নিজ বংশের কোনও মানুষের হাতে তোমার মুখাগ্নি জুটলো না। এ কেমন লীলা প্রভু তোমার!  বুঝেছি  রাজা হয়েও, গোপীজনের মনোহরা হয়েও, মহাভারতের সারথী হয়েও কেন তুমি সর্বহারা। বুঝেছি কেন বলেছিলে- কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন।নাহ, বাজেনি সেদিন পাঞ্চজন্য! কে বাজাবে!  তিনিই তো নেই আর। আছে শুধু ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ-- পাঞ্চজন্য নির্ঘোষ--সাধারণ পঞ্চজন-- পঞ্চায়েতি রাজ।

অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। পুড়ে ছাই শতমণ চন্দনকাঠ। কিমাশ্চর্যম!! তবুও সেই কৃষ্ণদেহ পুড়লো না একটুকুও। পুড়লো না একখানি কেশ তাঁর। বিস্ময় বিস্ময়। বিস্ময়ে হতবাক পঞ্চপাণ্ডব। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাহলে এখন উপায়!! তখন অকস্মাৎ দৈববাণী-- এই পরমপুরুষের দেহ কেন তোমরা দাহ করবার চেষ্টা করছো! স্বয়ং অগ্নিদেব তো তাঁরই আজ্ঞাধীন। তাঁর ক্ষমতা ও স্পর্ধা নেই এই দেহকে দাহ করার। তোমরা বরং রত্নালয় সমুদ্রজলে ভাসিয়ে দাও এই দেহ। রত্ন মিশে যাক রত্নালয়ে। অগত্যা তাই করলেন পঞ্চপাণ্ডব। চোখের জলে ভাসিয়ে দিলেন প্রিয় দেহটি সাগরের লবণজলে। তারপর!!! প্রবজ্যায় বেরোলেন পাঁচভাই। বহু দেশ ও তীর্থ ভ্রমণ করে এলেন নীলাচলে। জগন্নাথক্ষেত্রে শাস্ত্রসম্মত শ্রাদ্ধ করলেন শ্রীকৃষ্ণের। জায়গাটির নাম বৈকুণ্ঠ কোইলি। জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে একটি বাগান। জগন্নাথ - সুভদ্রা- বলরাম ত্রয়ীর নব কলেবর হওয়ার পর, পুরাতন কলেবর এখানেই সমাধিস্থ করা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন