মা মাটি ও রোবসন
উজান উপাধ্যায়
দেশের বাড়িতে এতদিনে
কাঠামোতে মাটি পড়ে গেছে।
চোখ মুখ স্পষ্ট পার্বতী ও তার ছানাপোনার।
কতক্ষণে বীরেন বাবু বলবেন --আয় মা , মাগো দশপ্রহরণধারিণী , সেই অপেক্ষায় মহাদেববাবুর গোটা পরিবার ।
কলাবৌ , মহিষাসুর আর আদিমতম প্রেমিকশ্রেষ্ঠ শিববাবু , যিনি বৌকে ছেলেমেয়েশুদ্ধু বাপের বাড়িতে রেখে একদিনও শান্তি পাননা !
সদলবলে ক্রমাগত বেড়ে উঠছেন খড়বিচুলিতে , ডাকের সাজে --
আসলে আমার মেয়েকে আমি মাটি বলে ডাকি , আমি জানি কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা অন্তত আজীবন ভালোবাসবে মেয়েটাকে আমার --
ওকে ছাড়া যে ঈশ্বরের ডেমো দেওয়া অসম্ভব , পুরাকাল থেকে আমার কন্যাই যে ভরসা অকালবোধনের।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে --শিউলি গন্ধে সারা গায়ে আগমনির সুর --
জানো তো বাবা , আমাদের স্কুলের উল্টো দিকে এত্ত এত্ত কাশফুল --
আমার মনে হচ্ছিল ওরা আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে --
বোধনের মন্ত্র পড়ছে কেউ আকাশবাণীতে -
দুচোখ জুড়ে অলকানন্দা --মেয়েকে যেই আরও একটু জড়িয়ে ধরতে যাবো অমনি তার রণচন্ডী রূপ ---অসুরনাশিনীর দশহাতে অজস্র আগ্নেয়াস্ত্র --
বাবা , আর কতদিন এভাবে ?
আমার কি কোনও দিন শান্তি করে বসে তোমার কবিতাগুলোতে ছাইভস্ম ছড়িয়ে দেবার ফুরসত আসবে না ?
সারাশরীরে লৌহবর্মের ধাতব হুঙ্কার , যোনিদেশে বজ্রহলকা --
দেবীপক্ষে অন্নপূর্ণা আর তার দুই মেয়েকে ধর্ষকদের হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে এসব কৌশল আমার মাটির ।মেয়ে আমার গোলাপবাগানে নিয়ম করে আগুন মেশায় --
মৃৎশিল্পী চক্ষুদান করছেন , পাঞ্চজন্যের ডাকে যুদ্ধের ভেরী বেজে উঠছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাজানো নাট্যদৃশ্যের অন্তরালে --
মেয়ে জোরসে চেঁচিয়ে উঠলে --বাবা শিগগিরই এসো , শুনবে না , এই দেখো টিভিতে বলছে --মেয়েদের গান গাওয়া নাকি এখনও নিষিদ্ধ অনেক পরিবারে ।
ছুটে গিয়ে দেখলাম--
মঞ্চে দাঁড়িয়ে মেয়ে।
হাতে একতারা , কাঁধ থেকে বুকের ওপর দিয়ে ছুঁয়ে গেছে শুকতারা প্রতিটি রাতেই , ঝুলে আছে গীটারের সাত তার , সমমেলে।
মেয়েটির গানের ভিতরে ঢুকে পড়ছে নদী , ভেসে যাচ্ছে উপত্যকা মায়াবী সুরের অনাবিল স্রোতে ,মেঘেরা জুড়েছে সাঁতার।
ভেঙে পড়ছে মেয়ে , আছড়ে পড়েছে আস্ত আকাশ বুকফাটা কান্নায়।
ভাতের থালায় পর্যাপ্ত সবজি পড়তো না , এমনকি চালচুলোহীন ঘরে চাদরে বালিশে উপোষের সংকেত। মা বাবা উপড়ে ফেললো দায় --
মাত্র সতেরোয় দিদা শিক্ষিত চাকুরে দেখে বেঁধে দিয়েছিল ঘর , বেঁচে যাবে গান , বেঁচে যাবে মন , বিদ্যেবুদ্ধি বেড়ে বেড়ে মস্ত ব্যাপার হবে।দিদার অন্ধতা স্পষ্ট হলো খুব শিগগিরই।
অক্টোপাসের প্যাঁচালো জিহ্বায় ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে কন্ঠনালী ,
করাত বসেছে দেশোয়ালি গানে , উদাত্ত বাউলের সুরেলা বন্দিশে।
সংসার ছেড়েছে মেয়ে , উনিশের গর্ভবতী , কোলের মেয়েকে নিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে ঝর্নাজল , ছিনিয়ে নিয়েছে মোৎসার্ট , সিম্ফনি , গোষ্টগোপাল লালন সাঁই আর লোকগাঁথা --গাইবার আজন্ম অধিকার--
মঞ্চ জুড়ে নেমেছে বৃষ্টি , গোলাপের পাপড়িতে ,সেতারের ঝংকারে ছোট্ট মেয়েটা মায়ের নাভি থেকে তুলে এনেছে প্রকৃতির গভীরে লুকিয়ে থাকা অনিন্দ্য মূর্ছনা , সরগম সরগম --রক জ্যাজ
পল্লীর গান।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে মেয়ে , শরীরে আত্মায় সংগীতের অপরূপ তাল লয় ছন্দ পেয়েও অধিকার কেড়ে নিতে হয় -যেমন লড়াই মল্লযুদ্ধে , যেমন লড়াই মেয়েদের ঘোমটায় ঢেকে রাখা অন্ধকার সুড়ঙ্গে উদ্ধত জিনস্ টপ স্কার্ট আর খোলাচুলে মেলে রাখা হেমন্তের মৃতদেহে জলতরঙ্গের মাদল বাজিয়ে নিতে।
মঞ্চ জুড়ে তছনছিয়ে গেয়ে যাচ্ছে মেয়ে , নটরাজ ছন্দে কিচিরমিচির নেচে যাচ্ছে তন্বী প্রস্রবণ --
আকাশচুর্ণ করে হেসে উঠলো মাটি , দশদিকে ছুটে ছুটে হাততালি --সদলবলে দলছুট পাখির মতো গলা ফাটিয়ে বলে উঠলো --
মিললো তো বাবা , বলেছিলাম কিনা --মেয়েরা নিষেধাজ্ঞা ছুঁড়ে ফেলে গেয়ে উঠবে অহল্যা পাষাণির ঘুম ভাঙিয়ে আগমনির গান।
অন্য ওথেলো , ডেসডিমনা-র
উজান উপাধ্যায়
কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে প্রিয়তমা,বোধনের অসাড় সময়ে -যদিও কাঙ্ক্ষিত নয় এই বিহ্বলতা।
তার যত গুনগুন গান কোথায় যে চাপা পড়ে যায় , বেদনার্ত গাছগুলো নালিশ জানিয়ে রাখে-
দিনগত ক্ষয়ে লেখা হয় স্তব, অতঃপর চঞ্চল সব নীরবতা।
এই যে হঠাৎ করে অসহিষ্ণু প্রিয়া , জেগে উঠছে লাভা , ভেতরের ক্লান্ত ঘরে ভেঙে যাওয়া প্রতিটি স্তরেই । এও কি আসলে কারও চতুর কৌশল ! প্রাকৃতিক হিমবাহ যেমন গলেছে জলবায়ু বুঝে--
নাকি স্তূপে স্তূপে জমা হওয়া ভগ্ন পরবাসে অকৃপণ আত্মসমর্থন!
তোমার বলয় ছুঁয়ে স্বার্থমগ্ন পুরুষের অক্ষাংশ বুঝে নেওয়া !
ঘূর্ণাক্ষে এত ঘুণ তোমাকে ভিতরে ভিতরে এত যে উত্তাপ দিয়ে যায় , তবুও তোমার এই রেগে যাওয়া আমি কিন্তু উপভোগ করি এবং কষ্ট পাই যদিও নাট্যাঙ্গনে অপলাপ হয়ে চলে যৌথ সংলাপের --
পৃথিবীর কোনও দ্রাঘিমায় আর কি পুরুষ আছে কেউ , তোমার রুগ্ন রিপুগ্রস্থ ঠোঁটে বুনে যাচ্ছে ব্যক্তিগত শোক ফুরিয়ে ফেলার মতো উপযুক্ত ঢেউ --
এত ধান্দাবাজ প্রেমিক আছে কি কেউ , আমার মতোন-
নিজের উল্লাসে নভোনীল আলোক সম্পাতে দহনজাত খাদে যার আদ্যোপান্ত প্রিয়া-সমর্পণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন