বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮

উমা পর্ব--১৪



মা মাটি ও রোবসন

উজান উপাধ্যায়


দেশের বাড়িতে এতদিনে

কাঠামোতে মাটি পড়ে গেছে।


চোখ মুখ স্পষ্ট পার্বতী ও তার ছানাপোনার।


কতক্ষণে বীরেন বাবু বলবেন --আয় মা , মাগো দশপ্রহরণধারিণী , সেই অপেক্ষায় মহাদেববাবুর গোটা পরিবার ।


কলাবৌ , মহিষাসুর আর আদিমতম প্রেমিকশ্রেষ্ঠ শিববাবু , যিনি বৌকে ছেলেমেয়েশুদ্ধু বাপের বাড়িতে রেখে একদিনও শান্তি পাননা !


সদলবলে ক্রমাগত বেড়ে উঠছেন খড়বিচুলিতে , ডাকের সাজে --


আসলে আমার মেয়েকে আমি মাটি বলে ডাকি , আমি জানি কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা অন্তত আজীবন ভালোবাসবে মেয়েটাকে আমার --


ওকে ছাড়া যে ঈশ্বরের ডেমো দেওয়া অসম্ভব , পুরাকাল থেকে আমার কন্যাই যে ভরসা অকালবোধনের।


সেদিন স্কুল থেকে ফিরতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে --শিউলি গন্ধে সারা গায়ে আগমনির সুর --


জানো তো বাবা , আমাদের স্কুলের উল্টো দিকে এত্ত এত্ত কাশফুল --

আমার মনে হচ্ছিল ওরা আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে --


বোধনের মন্ত্র পড়ছে কেউ আকাশবাণীতে -


দুচোখ জুড়ে অলকানন্দা --মেয়েকে যেই আরও একটু জড়িয়ে ধরতে যাবো অমনি তার রণচন্ডী রূপ ---অসুরনাশিনীর দশহাতে অজস্র আগ্নেয়াস্ত্র --


বাবা , আর কতদিন এভাবে ?

আমার কি কোনও দিন শান্তি করে বসে তোমার কবিতাগুলোতে ছাইভস্ম ছড়িয়ে দেবার ফুরসত আসবে না ?


সারাশরীরে লৌহবর্মের ধাতব হুঙ্কার , যোনিদেশে বজ্রহলকা --


দেবীপক্ষে অন্নপূর্ণা আর তার দুই মেয়েকে ধর্ষকদের হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে এসব কৌশল আমার মাটির ।মেয়ে আমার গোলাপবাগানে নিয়ম করে আগুন মেশায় --


মৃৎশিল্পী চক্ষুদান করছেন , পাঞ্চজন্যের ডাকে যুদ্ধের ভেরী বেজে উঠছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাজানো নাট্যদৃশ্যের অন্তরালে --


মেয়ে জোরসে চেঁচিয়ে উঠলে --বাবা শিগগিরই এসো , শুনবে না , এই দেখো  টিভিতে বলছে --মেয়েদের গান গাওয়া নাকি এখনও নিষিদ্ধ অনেক পরিবারে ।


ছুটে গিয়ে দেখলাম--


মঞ্চে দাঁড়িয়ে মেয়ে।

হাতে একতারা , কাঁধ থেকে বুকের ওপর দিয়ে ছুঁয়ে গেছে শুকতারা প্রতিটি রাতেই , ঝুলে আছে গীটারের সাত তার , সমমেলে।


মেয়েটির গানের ভিতরে ঢুকে পড়ছে নদী , ভেসে যাচ্ছে উপত্যকা মায়াবী সুরের অনাবিল স্রোতে ,মেঘেরা জুড়েছে সাঁতার।


ভেঙে পড়ছে মেয়ে , আছড়ে পড়েছে আস্ত আকাশ বুকফাটা কান্নায়।


ভাতের থালায় পর্যাপ্ত সবজি পড়তো না , এমনকি  চালচুলোহীন ঘরে চাদরে বালিশে উপোষের সংকেত। মা বাবা উপড়ে ফেললো দায় --


মাত্র সতেরোয় দিদা শিক্ষিত চাকুরে দেখে বেঁধে দিয়েছিল ঘর , বেঁচে যাবে গান , বেঁচে যাবে মন , বিদ্যেবুদ্ধি বেড়ে বেড়ে মস্ত ব্যাপার হবে।দিদার অন্ধতা স্পষ্ট হলো খুব শিগগিরই।


অক্টোপাসের প্যাঁচালো জিহ্বায় ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে কন্ঠনালী ,

করাত বসেছে দেশোয়ালি গানে , উদাত্ত বাউলের সুরেলা বন্দিশে।


সংসার ছেড়েছে মেয়ে , উনিশের গর্ভবতী , কোলের মেয়েকে নিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে ঝর্নাজল , ছিনিয়ে নিয়েছে মোৎসার্ট , সিম্ফনি , গোষ্টগোপাল লালন সাঁই আর লোকগাঁথা --গাইবার আজন্ম অধিকার--


মঞ্চ জুড়ে নেমেছে বৃষ্টি , গোলাপের পাপড়িতে ,সেতারের ঝংকারে ছোট্ট মেয়েটা মায়ের নাভি থেকে তুলে এনেছে প্রকৃতির গভীরে লুকিয়ে থাকা অনিন্দ্য মূর্ছনা , সরগম সরগম --রক জ্যাজ

পল্লীর গান।


মঞ্চে দাঁড়িয়ে মেয়ে , শরীরে আত্মায় সংগীতের অপরূপ তাল লয় ছন্দ পেয়েও অধিকার কেড়ে নিতে হয় -যেমন লড়াই মল্লযুদ্ধে , যেমন লড়াই মেয়েদের ঘোমটায় ঢেকে রাখা অন্ধকার সুড়ঙ্গে উদ্ধত জিনস্ টপ স্কার্ট আর খোলাচুলে মেলে রাখা হেমন্তের মৃতদেহে জলতরঙ্গের মাদল বাজিয়ে  নিতে।


মঞ্চ জুড়ে তছনছিয়ে গেয়ে যাচ্ছে মেয়ে , নটরাজ ছন্দে কিচিরমিচির নেচে যাচ্ছে তন্বী প্রস্রবণ --


আকাশচুর্ণ  করে হেসে উঠলো মাটি , দশদিকে ছুটে ছুটে হাততালি --সদলবলে দলছুট পাখির মতো  গলা ফাটিয়ে বলে উঠলো --


মিললো তো বাবা , বলেছিলাম কিনা --মেয়েরা নিষেধাজ্ঞা ছুঁড়ে ফেলে গেয়ে উঠবে  অহল্যা পাষাণির ঘুম ভাঙিয়ে আগমনির গান।


অন্য ওথেলো , ডেসডিমনা-র

উজান উপাধ্যায়




কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে প্রিয়তমা,বোধনের অসাড় সময়ে -যদিও কাঙ্ক্ষিত নয় এই বিহ্বলতা।


তার যত গুনগুন গান কোথায় যে চাপা পড়ে যায় , বেদনার্ত গাছগুলো নালিশ জানিয়ে রাখে-

দিনগত ক্ষয়ে লেখা হয় স্তব, অতঃপর চঞ্চল সব নীরবতা।


এই যে হঠাৎ করে অসহিষ্ণু প্রিয়া ,  জেগে উঠছে লাভা , ভেতরের ক্লান্ত ঘরে ভেঙে যাওয়া প্রতিটি স্তরেই । এও কি আসলে কারও চতুর কৌশল ! প্রাকৃতিক হিমবাহ যেমন গলেছে জলবায়ু বুঝে--

নাকি স্তূপে স্তূপে জমা হওয়া ভগ্ন পরবাসে অকৃপণ আত্মসমর্থন!

তোমার বলয় ছুঁয়ে স্বার্থমগ্ন পুরুষের অক্ষাংশ বুঝে নেওয়া !


ঘূর্ণাক্ষে এত ঘুণ তোমাকে ভিতরে ভিতরে এত যে উত্তাপ দিয়ে যায় , তবুও তোমার এই রেগে যাওয়া আমি কিন্তু উপভোগ করি এবং কষ্ট পাই যদিও নাট্যাঙ্গনে অপলাপ হয়ে চলে যৌথ সংলাপের --


পৃথিবীর কোনও দ্রাঘিমায় আর কি পুরুষ আছে কেউ , তোমার রুগ্ন রিপুগ্রস্থ ঠোঁটে বুনে যাচ্ছে ব্যক্তিগত শোক ফুরিয়ে ফেলার মতো উপযুক্ত ঢেউ --


এত ধান্দাবাজ প্রেমিক আছে কি কেউ , আমার মতোন-

নিজের উল্লাসে নভোনীল আলোক সম্পাতে দহনজাত খাদে যার আদ্যোপান্ত প্রিয়া-সমর্পণ।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন