রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৯

উজান উপাধ্যায়


আমার দুজন প্রাক্তন প্রেমিকা

উজান উপাধ্যায়


ঠাকুরদার সামনে ঘোমটা খসতোনা ঠাকুমার , সুখদাসুন্দরী -আমার সামনে খসে যেত ঠাকুমার গায়ের গন্ধ , রাত্রিতে এক বিছানায়-আমি তখন এক থেকে চোদ্দো গুনেছি -জানলায় উঁকি দিত জাম ও জামরুল গাছের পাতারা।

প্রায় অক্ষরজ্ঞানহীন রাতে ঠাকুমা গল্প বলতো বাবার ছোটবেলার , বাবার বটগাছ হয়ে ওঠার গল্প। ঠাকুরদা হাসতেন -তৃপ্তির ঢেঁকুরে এত খুশি , আমাদের বাড়িতে প্রতিটি ঋতুর ফুল , পাখি আর আত্মমগ্ন নদীরা আসতে , সারাবছর ওদের জমাটি আড্ডায় আমাকে ঠাকুমা চিনিয়ে দিত -নিশ্চুপ ঝাউপাতার ভিতরে কিভাবে প্রেম বাড়ে ছায়ার দৈর্ঘ্যের সাথে আবার ছোট ছোট খন্ডে ভেঙে ছড়িয়ে যায় তুলসীবেদিতে।

কবিরাজ ঠাকুরদার বিশল্যকরণী তৈরির মূল উপাদান ঠাকুমার চোখের ভিতরে রাখা ছিল , হামানদিস্তায় কিভাবে গুঁড়িয়ে যেত নৈঃশব্দ্যগহীন --প্রেমিকা কতটা নীরব হলে বাড়িতে আরোগ্য আসে বধূসাজের প্রসন্ন ঘেরাটোপে-কখনো কখনো জল খেয়ে রাতের ঘুমডাকা দিনগুলোতে দেখেছি ঝুলে থাকা অন্ধকারের স্তন --ওখানেই পাহাড় জন্মেছে -ওখানেই পিতামহ একদিন সাঁকো পার হতে চড়েছেন বৃত্তস্পর্শকের ছোঁয়াচ রক্তবাহে তুফানিয়া এনে।

স্বর্ণময়ী , আমার দিদা -গম্ভীর পন্ডিত সত্যরঞ্জন বাবু -আমার মাতামহের প্রবল ব্যক্তিত্বও যে কোমলতায় গৌন হয়ে গেছে। মায়ের ঠাকুমার কাছ থেকে পাওয়া সব কুসংস্কার , প্রবচনশিক্ষা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতো দিদা।

আয়তো সোনা -বলে ডাকলেই ছুটে গিয়ে আঙুল চাটতাম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাঁধুনিরা হিমশিম খেতো সেসব রান্না একবার চেখে নিলে।

আমার দুইপ্রেমিকা , দু দুটো পাখির চোখে ছায়া রেখে গেছে , আজও খুব দুঃখ পেলে নৌকা বেয়ে চলে যাই , যেখানে ওদের খুনসুটি , দুইবোনের হাতে উল কাঁটা , বুনে চলা অগুনতি শোয়েটার --আমার জন্য --

দুজনের চিতায় আমার সহমরণ হয়েছে দু দুবার , এখন যে ধোঁয়া ধুলো , আত্মজাকে নিয়ে হেঁটে চলা , আকাশের কার্নিশে রোজ ওদের চুম্বনেই অন্তরমহলেবেড়ে ওঠে কাঁধে রাখা মাটির শিকড় -গভীরের কলঘরে , শীতলক্ষ্যার নাভির ভিতর।

আমার ফেলে আসা ঠিকানায় রোজ রোজ ওদের চিঠি আসে --অন্ধকার গভীরে না গড়ালে সে সব প্রেমের অক্ষরে বৃষ্টি আসেনা।

তাঁবু মই আর লবনাক্ত দৌড়ে ক্রমাগত ভিজে ওঠা দু জোড়া ঠোঁটে আমার বার্ধক্যের অপেক্ষা।

আমার প্রাক্তন প্রেমিকারা , আরও যারা যারা , এই দুই বুকেই পরিপূর্ণ হয় , যথাযথ লাবন্য কুড়িয়ে পেলে। জাহাজ ভর্তি শোয়েটার আর নারকেল চিংড়ি , পটলপোস্ত রান্না হয় নন্দনের পারিজাত ঠাসা উনুনে উনুনে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন