উজাগরী // পঙ্কজ কুমার সরকার
কালো বেড়ালের হলুদ মণিতে যতটা ভয়,
সাপের লেজ ততটা দীর্ঘ নয়,
ততটা গভীর নয় তার বিষ থলি ;
ক'জন বোঝে কেন এ সব কথা বলি !
ক'জন বোঝে
ক্ষমা ঠিক কতদূর দুর্বলতা ?
ক'জনই বা বোঝে--
আত্মগোপনে থাকা কতটা উচিৎ ;
কিম্বা, কতটা খুঁড়লে গর্ত,
শক্ত হয় বাড়ির ভিত ...
তুমি হয়ত ভাবছো --
কী লাভ এ সব তত্ত্বকথা বুঝে ?
আমি কি বানাব বাড়ি !
না কি আমার কখনও
প্রয়োজন হবে ক্ষমার !
একান্তে বলে রাখি ---
তোমার এ ভাবনাও অমূলক নয় হয়ত ;
তবু, গোলাপকে যারা প্রেম বলে জানে ,
অথচ তার কাঁটাকে ভাবে অবান্তর,
তারাও একদিন বুঝবে --
পাপড়ির সাথে গোলাপের
কাঁটাটাও কতটা সংগত...
তারাও বুঝবে -- ভালোবাসা গভীর হলে --
প্রতীক্ষাও কিভাবে মধুর হয়ে ওঠে ;
বুঝবে, কতটা প্রযত্ন পেলে --
কাঙ্ক্ষিত বর্ণ গন্ধ ফুল হয়ে ফোটে !
বুঝবে,
আমাদের যে অর্জিত স্বাধীনতা
তাও কোন বিমূর্ত বিষয় নয় ।
গোলাপের মতো সেও এক মূর্ত বিস্ময় !
উপরে উপরে তার পতাকার ঘটা ;
অথচ বেদিমূলে লুকোনো রয়েছে
শত শহীদের রক্ত আর
দেশ ভাগের উদ্বাস্তু কাঁটা !
বুঝবে , আমাদের স্বাধীন দেশের মেয়রা
এখনও কতটা শিকড়হীন,
এখনও তাদের মন নয়
শরীর নিয়েই কথা হয় !
ভালো মেয়ে হয়ে ওঠার সস্তা মোড়কে ঢুকে
তারা অতি অনায়াসে
অহল্যা সীতা-পাঞ্চালী হয়ে যায় ;
খোলসটা কিছুতেই এড়াতে পারে না !
তাই তো মেয়ের জন্ম মানেই
বাবার কপালে অজস্র ভাঁজ,
সংসারে নেমে আসে সমূহ বিপদ -লাজ ,
এখনও তারা যেন
আনমনা কোনো কিশোরীর
আপন খেয়ালে গাঁথা বুনো ফুলের মালা ;
কোন পুজোয় লাগে না ,
অথচ বুকে করে বয়ে বেড়ায়
সূঁচের আঘাত, সুতোর যন্ত্রণা...
কিম্বা তারা যেন
কোন এক পোড়ো বাড়ির বেড়ার ধারে
আপনি গজিয়ে ওঠা লতা ,
মধু খেয়ে যায় মৌ মাছি,
ফল খেয়ে যায় -- বউকথাকও
অথচ মনে মধ্যে লুকিয়ে রাখে
অযথা প্রচুর অশ্রু বিধুর আত্ম যাপন কথা...
আমাদের এদেশের মেয়েরা
জন্ম থেকেই জানে ---
পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমংতপঃ
অথচ সেই পিতাও
তাদের মন বুঝতে চাননি কখনও,
যদি চাইতেন তারাও এই জীবনেই
সুপ্রীতি বর্মন কিম্বা মেরি কম হতে পারত. ..
কিন্তু হয় না,
হয় না বলেই প্রতিটা মেয়েই একদিন
আত্ম কেন্দ্রের সন্ধানে স্বপ্নের দরজায় --
কাসার থালায় দুধ পুকুরে আলতা ধুয়ে --
প্রবেশ করে এক নতুন ঠিকানায় ,
সেখানে এসে তারা ভাবে --
এখানেই শিকড় ছাড়ব আচ্ছা রকম,
এখানেই ভাগ ভাগ করে নেব
সদ্য আপন কারো বিছানা বালিশ ,
অথচ দু'দিন যেতে না যেতেই
সে বাড়িটাও তাদের বুকে জমিয়ে তোলে
হাজারো নালিশ,
মধ্যে পড়ে বর্ণ হারায়
ও বাড়ির তত্ত্বে পাঠানো নেল পালিশ...
বুঝতে পারে, তাদের শীতার্ত সিঁথিতে
বসন্ত বাহার হয়ে ফুটেছে যে সিঁদুর গোলাপ
তারই নীচে লুকিয়ে রয়েছে
হাজার নিষেধের কাঁটার প্রলাপ !
সেই সব কাঁটায় কাঁটায় ভয়
ভয়ে ভয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণা ;
স্বপ্ন আহ্লাদ দু' দিনেই উধাও !
কোথাও মেলে না মুক্তির মন্ত্রণা ....
দেখে ; তাকে সন্তানবতী করেছে যে পুরুষ,
সেও মনে মনে বিকিয়ে আছে অন্য কাথাও ।
কাঁটার আগল ভেঙে বেরোতেও
মেলে না সামান্য প্রশ্রয় !
ঘরে-বাইরে সন্দেহ তিরে
কেবলই বিদ্ধ হতে হয়, দ্বিগুণ ব্যথায় ।
যে বাড়ির মাঙ্গল্যে তারা ব্রত রাখে
নির্জলা উপোস করে, দুধ কলা দেয়,
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালে তুলসি তলায়...
সে বাড়িও ক্রমে ক্রমে
তাদেরই বুকে জমিয়ে তোলে
অবিশ্বাসের অন্ধকার !
অথচ
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ,
সংসারের ছেঁড়া বোতাম গুলোকে
তারা সেলাই করতে বসে,
ঘুম ঘুম চোখে
আঙুলে সূচের খোচা খেয়ে ;
আৎকে উঠে শুনতে পায়,
হৃদপিণ্ডের অলিন্দে ব'সে ব'সে
কারা যেন, আজীবনের অব্যক্ত --
ব্যথার উপর হাত রেখে বলছে -- ইস্ !
ঠিক তখনই তাদের বুকের খু-ব গভীরে,
জেগে ওঠে এক অমোঘ উচ্চারণ ---মা...
আজীবন সঞ্জাত ব্যথার মধ্যে তারা যেন
হঠাৎই শুনতে পায়
এক জলদ গম্ভীর মাতৃ বন্দনা .....
মনে হয় , বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠ বেয়ে
নেমে আসছে এক অলীক ভোর....
সেই বন্দনার মধ্যে
অপরিচিত এক প্রাচীন রমণী
অতি মৃদু কণ্ঠে বলে চলেছে --
ও মেয়ে ভয় পেওনা ,
আশারা এখনও মরেনি --
সত্ত্বারা জেগে আছে...
----------------------
পঙ্কা অসাধারণ লিখেছিস।
উত্তরমুছুন