সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০১৯

বিশেষ আকর্ষণ: অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়

## বিশেষ আকর্ষণ: প্রথম ভাগ,,,,


বিবাহ রীতিতে তবে কি নবতম সংযোজন --ধর্না বিবাহ?

অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়


ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্ষঃ প্রাজপত্যস্তথাসুরঃ।
গান্ধর্ব্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।।

(মনুসংহিতা - তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক-২১)


ব্রাহ্ম,দৈব,আর্ষ,প্রাজপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,
রাক্ষস এবং সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পৈশাচ। বলা হয় এই আটরকম বিবাহের প্রচলন প্রাচীনকাল থেকে আর্য সমাজে চলে আসছে।  এখন এই প্রাচীনকাল বলতে কতখানি প্রাচীন তা একটু খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। মহাভারতের উপাখ্যানগুলির মধ্যে একটি খুব বিখ্যাত ঋষি উদ্দালকের উপাখ্যান। তাঁর আসল নাম যদিও উদ্দালক ছিল না। তিনি ছিলেন ধৌম্য নামক এক ঋষির শিষ্য। পূর্বনাম আরুণি। আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন পড়াশুনো করা এতোটা সহজসাধ্য ও হেলাফেলার ব্যাপার ছিল না। গুরুগৃহে অধ্যয়ন ছিল রীতিমত কৃচ্ছ্রসাধন। গুরুগৃহে অধ্যয়ন ছাড়াও গুরু তার শিষ্যকে নিয়ে এটা ওটা করিয়ে নিতেন। এতে যেমন শিষ্যের গুরুনিষ্ঠার পরিচয় নেওয়া হতো সাথে সাথে শিষ্যের চরিত্রগঠন‌ও হয়ে যেত। ধৌম্য ঋষি একদিন শিষ্য আরুণিকে তার খেতের আল পরিচর্যা করতে পাঠান। আরুণি খেতে পৌঁছে দেখেন আল ভেঙে সব জল গলে চলে যাচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও আরুণি আল পুনরায় বাঁধতে পারলেন না। কিন্তু, গুরুর আদেশ বলে কথা। তাই শেষমেশ আরুণি খেতের মধ্যে শুয়ে পড়ে নিজের দেহ দিয়ে আলের জল আটকে রাখলেন। দীর্ঘক্ষণ আশ্রমে ফিরতে দেরী দেখে এদিকে ঋষি ধৌম্য‌ও তো শিষ্যের দুশ্চিন্তায় মাঠে এসে উপস্থিত। এসে শিষ্যের কান্ড দেখে গুরুর চক্ষুস্থির। শিষ্যের গুরুনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে গুরু তার কাছে যা যা জ্ঞান ছিল সকল‌ই প্রদান করলেন। এক‌ইসাথে আল থেকে উত্থিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করবার জন্য আরুণির নতুন নাম হল "উদ্দালক"।

বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি আর্য সমাজে স্থাপন করার পেছনে যে নামদুটি আসবে সেই দু'টি এই ঋষি উদ্দালক এবং তার পুত্র শ্বেতকেতু। একদিন শ্বেতকেতু আশ্রমে বসে রয়েছেন তার মাতা-পিতার সঙ্গে। এমন সময়ে কোত্থেকে এক ঋষি এসে তাঁর মাতাকে কামনা করে বসলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর মাতাকে যেতেই হল। শ্বেতকেতু রেগে প্রতিবাদ করে উঠলে সংযতচিত্ত পিতা বললেন, বৎস! ‌এই তো সংসারের দস্তুর। এই সংসারে কামাবিষ্ট হয়ে সকল প্রাণীই বিপরীত লিঙ্গকে কামনা করে থাকে‌। মানুষ‌ও এই প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত নয়। শ্বেতকেতু আশ্বস্ত হলেন না। বরং মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। এই শ্বেতকেতুই বড় হয়ে পন্ডিত হয়ে যখন গুরুগৃহ থেকে ফিরলেন, তিনিই নিয়ম বেঁধে দিলেন পতিভিন্ন অন্য পুরুষ সংসর্গ এবং পত্নীভিন্ন অন্য নারী সংসর্গ পাপ বলে মান্য হবে। এখন আজকের এই সমাজে দাঁড়িয়ে "পাপ বলে মান্য হবে" --- এই ব্যাপারটা খুব একটা কঠোর বলে মনে না হলেও সে যুগে পাপের একটা বড় ভূমিকা ছিল। মানুষ পাপ কাজ করে ইহলোকে সমাজচ্যুত হবার এবং পরলোকে নরকভোগের ভয় পেত।


এখন মানুষের মন থেকে এই পাপ নামক ভয়টাই সরে গেছে নাস্তিক্যবাদের প্রভাবে। মানুষ একমাত্র ভয় পায় আইন কে। সে জানে আইনের চোখে ধুলো দিয়ে যদি একবার বেরিয়ে আসতে পারি তাহলেই কেল্লাফতে। পাপ কাজ করে যদি টাকা ও ক্ষমতা হয় তো সমাজচ্যুত কেউ করবে না। আর পরলোকের ওপর তো বিশ্বাস‌ই নেই। আগে এই পরলোকের বিশ্বাসটাই ছিল মুখ্য। মানুষ বিশ্বাস করতো লোকসমাজের হাত থেকে রক্ষা পেলেও মৃত্যুর পর যে বিচার হবে সেখানে ফাঁকি নেই। যাইহোক, এভাবে বিয়ের প্রচলন হয়ে গেল। 

স্পষ্টত‌ই শ্বেতকেতুর মনে বিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্য পুরুষতান্ত্রিকতার প্রসার ছিল না। নারী ও পুরুষ উভয়কেই তিনি সামাজিক সুরক্ষা দান করেছিলেন। পরবর্তী কালে সামাজিক নিয়মগুলো আর‌ও সুশৃঙ্খলভাবে হতে লাগল স্মৃতির যুগে। ভারতবর্ষের স্মৃতিগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সর্বাধিক বিতর্কিত অবশ্যই মনুসংহিতা। মনু এই নিয়মগুলোকেই আরেকটু সুবিন্যস্ত করে দিলেন। সেইসময় আর্য জনসংখ্যা বিস্তার প্রয়োজন ছিল। তাই অন্যান্য জনজাতির সঙ্গেও আর্যরা বৈবাহিক রীতিতে আবদ্ধ হোক --- ব্যাপারটাকে ধর্মীয় অনুমোদন দেওয়া জরুরী ছিল। কিন্তু, সবক্ষেত্রেই যে পরিবার ও আত্মীয়বর্গ মেনে নেবে এমন নয়। কোন‌ও ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর পরিবার কে না জানিয়ে, কোন‌ও ক্ষেত্রে পাত্রীর বাড়ি থেকে পাত্রীকে প্রায় তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে হতো। এখন এসব বিবাহ কে মান্যতা না দিলে তারা আর্যসমাজ বহির্ভূত হয়ে যাবে। জনসংখ্যা আর বাড়বে কি? আবার অপরদিকে এভাবে বিয়ে গুলো যাতে অনাচার না হয়ে দাঁড়ায় সেইজন্য বিয়েগুলোর "ক্লাস" বেঁধে দেওয়া হল। এই এই ভাবে বিয়ে উচ্চবর্ণের লোকেরা করতে পারবে, এই এই ভাবে পারবে না। নিম্নশ্রেণির বিয়েগুলো মেনে নেওয়ার সাথে সাথে সেগুলো কে সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তার শর্ত‌ও চাপিয়ে দেওয়া হল। কাউকে বহিষ্কার নয় বদলে সবাইকে ধর্মের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে আচারের নিয়মে বেঁধে ফেলা।


##বিশেষ আকর্ষণ: দ্বিতীয় ভাগ,,,,, 

ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যদি আমরা আটরকমের বিবাহরীতি একটু আলোচনা করে নিই। 

আচ্ছাদ্য চার্চ্চ্যয়িত্বা চ শ্রুতিশীলবতে স্বয়ম্। 
আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ।। 

( মনুসংহিতা - ৩/২৭)

"ব্রাহ্ম বিবাহ"
*************

শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন ও চরিত্রবান পাত্রকে কন্যাপক্ষরা স্বয়ং আহ্বান করে যথোচিত অভ্যর্থনা করে কন্যাকে সুচারুবস্ত্রে আচ্ছাদিত ও অলংকারে ভূষিত করে ঐ পাত্র কে যদি সম্প্রদান করে তাকে "ব্রাহ্ম বিবাহ" বলে। 

যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্ব্বতে। 
অলঙ্কৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্ম্মং প্রচক্ষতে।। 

(মনুসংহিতা - ৩/২৮)


"আর্য বিবাহ"
**************

যজ্ঞের পুরোহিত কে সালঙ্কারা কন্যা দান করা হলে এইরকম বিবাহ কে বলা হত দৈব বিবাহ। পাত্রীপক্ষ আবার রীতি অনুযায়ী যৌতুক গ্রহণ করতেও পারতেন। গাভী ও বৃষকে একত্রে গো-মিথুন বলা হত। এইভাবে গো-মিথুন দান হিসাবে গ্রহণ করে পাত্রীপক্ষ যখন কন্যাকে বরের হাতে তুলে দিত সেই বিয়ের নাম ছিল আর্য বিবাহ। 


"প্রাজপত্য বিবাহ"
******************

"তোমরা একত্রে গার্হস্থ্য ধর্মের পালন করো" এই বলে অর্চনাপূর্বক কন্যা প্রদান করে যে বিয়ের প্রচলন তাকেই বলে প্রাজপত্য বিবাহ। বলাই বাহুল্য আজকের সমাজে তথাকথিত পুরোহিত ডেকে যে "আরেঞ্জ ম্যারেজ" তা আর কিছুই নয় প্রাজপত্য বিবাহ। 

এখন সমাজে সবচেয়ে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণদের এই চার রকম বিবাহের বাইরে যাবার অনুমোদন ছিল না। বর্ণানুক্রমে নীচের দিকের নিয়মগুলো একটু ঢিলেঢালা। যেমন ক্ষত্রিয়রা আসুর ও গান্ধর্ব বিবাহ করতে পারতেন। এক্ষেত্রে পাত্র রীতিমত নিজের অর্থবল প্রদর্শন করে প্রচুর যৌতুক দিয়ে কন্যা ও কন্যার পিতামাতা কে সন্তুষ্ট করে কন্যাকে ঘরে নিয়ে আসতেন।

 গান্ধর্ব বিবাহ হল এখনকার লাভ ম্যারেজ। পাত্র-পাত্রীর একে অপরকে পছন্দ হলেই হয়ে গেল। কারোর অনুমতি লাগবে না। রাক্ষস বিবাহ হচ্ছে কন্যাকে অপহরণ করে বিবাহ। বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষেই এই বিবাহ উচিত ছিল। 

ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তখন‌ই এই বিবাহ সম্ভব ছিল যখন এই অপহরণে কন্যার সম্মতি ষোলোআনা। এটা গান্ধর্ব আর রাক্ষস বিবাহের মিশ্রণ। মহাভারতে অর্জুন ও সুভদ্রার বিয়ে এই মতে হয়েছে। সবচেয়ে নিম্নমানের বিবাহ ছিল পৈশাচ বিবাহ। 

"পৈশাচ বিবাহ"
*****************

নিদ্রিতা, নেশাচ্ছন্না কিম্বা প্রমত্তা নারীতে উপগত হবার নাম পৈশাচ বিবাহ। প্রকৃতপক্ষে এটা ধর্ষণ। তবুও একে বিবাহের নাম কেন দেওয়া হল? তখনকার সমাজ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে, যাতে এমন ঘটনায় জন্মানো সন্তান পিতৃপরিচয় পায় আর ঘটনার শিকার নারীটির‌ও ভরণপোষণের দায়িত্ব যাতে পুরুষটি নেয় তাঁর বন্দোবস্ত করাই এক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য। মনু বলেই দিচ্ছেন এ হচ্ছে পাপের বিবাহ। সবচেয়ে অধম। তবু, ঘটনা ঘটে গেলে তাকে স্ত্রী বলে অস্বীকার করাটা আর‌ও অধর্মের আচরণ হয়ে যাবে। 

খুব বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে রচনা এইসব নিয়ম। কালের নিয়মে ক্ষয়ে গেলেও এতগুলো বছরে কিছু একেবারে ভেঙে পড়তে পারেনি আমাদের হিন্দু বিবাহের রীতিনীতির ক্ষেত্রে।


## বিশেষ আকর্ষণ : তৃতীয় ভাগ,,,,,, 

এবারে একেবারে হাজির হয়ে যাবো হালের একটি ঘটনায়। একটি বিয়ের ঘটনা। পাত্রের নাম অনন্ত বর্মন। পাত্রীর নাম লিপিকা। স্থান জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি এলাকা। হ্যাঁ। কেউই ভোলেন নি জানি। কি ঘটেছিল ঠিক? দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রেম দুজনের। তারপর মেয়েটির বাড়িতে মেনে নেয়নি। প্রেমিকার বিয়ে অন্য কোথাও হচ্ছে জানতে পেরে প্রিয়তমার বাড়ির সামনে ধর্নায় বসে পড়লেন প্রেমিক। হাতে প্লাকার্ড। দুজনের সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারে এমন বেশকিছু ছবি। সঙ্গে সঙ্গে লোক জড়ো হয়ে গেল। কেউ কেউ প্রেমিকের সমর্থনে। আর কেও নিছক মজা দেখতে। আর আমরা কি করলাম। নেট দুনিয়ায় দায়িত্ব নিয়ে ভাইরাল করলাম এই ধর্নার খবর। একটা সময়ে লিপিকা আর তার পরিবারের উপর মানসিক চাপ বাড়তে লাগল এইভাবে। সারা দেশ দেখছে। সম্মানের খাতিরে পরিবার রাজী হয়ে গেল। বিয়ে হল দুইজনের। সেই বিয়ের ভিডিও যথারীতি ভাইরাল হল। কিন্তু, আমরা কি দেখলাম সেই ভিডিও তে। পাত্রীর চোখেমুখে পরাজয়ের গ্লানি। অপমানের চিহ্ন তার মুখে। দীর্ঘ আটবছর প্রেম করেছে যে ছেলের সাথে তার হাতের সিঁদুর পড়তে গিয়েও যখন একজন নারীর মুখের অভিব্যক্তি এইরকম তখন কিছু প্রশ্ন থেকে যায় ব‌ইকি। যারা যারা এটাকে প্রেমের জয় হিসাবে দেখছেন প্রশ্নচিহ্নটা তাদের দিকে। আটবছরের প্রেমের পরেও একজন মেয়েকে যখন জোর করে বিয়ে করতে হল তখন প্রেম জিতল না হারল? প্রেমের কথা ছেড়ে দিন,সংসার সুখী হবে তো তাদের? বিয়ের যে পবিত্রতা সেটা আজ কোথাও কি আরো খানিকটা নেমে গেল না? 

আসলে আমাদের সমাজে প্রেম ফেল করে দেবদাস হয়ে যাওয়ার কিন্ত একটা আলাদা রোমান্টিসিজম আছে পাবলিকের মনে। এখন‌ও 'কবীর' এর মতন প্রেমে ধাক্কা খেয়ে নেশায় ডুবে যাওয়া চরিত্র কত কত প্রেমিক প্রেমিকার আইডল। কিন্তু, সত্যিকারের জীবন মানে এরকম হেরে যাওয়া নয়। সত্যিকারের প্রেম মানে স্বাধীনতা। জীবন আর প্রেম তখন‌ই সমার্থক হবে, যখন জয় আর স্বাধীনতাও সমার্থক। 

আগামীতে ছড়িয়ে পড়বে এই প্রবণতা। ইতিমধ্যেই বেশকিছু ঘটনা সামনে এসেছে। কারণ,আমরা দায়িত্ব নিয়ে বসে আছি এই সমস্ত ঘটনা ভাইরাল করতে। একটা প্রশ্ন তাই বারবার এসে যায়, হিন্দু বিবাহ রীতিতে কি তবে নবতম সংযোজন--- ধর্না বিবাহ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন