বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০

লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল: প্রতীক্ষার অভ্যাস


নেতিবাচক প্রতীক্ষার অভ্যাস

লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল



আগুন ধরতে সময় লাগল কয়েক মুহূর্ত । তারপর আর কিচ্ছু দেখা যায় না । শুধু আগুনের দাউ দাউ শিখা । আমরা যারা বারো বোঝা কাঠ মাথায় বয়ে নিয়ে এসেছি তারা অপেক্ষা করছি প্রিয় মানুষটির মৃতদেহটি পুড়ে যাবার ।  তাঁর শরীর টাকে ছাই করে দিতে কত না আয়োজন  ।  বাতাস দিচ্ছে খুব  -গরম বাতাস  - কিছু লোকের চোখের তলায়  জলের চকচকে দাগ ।  তার সাথে টিপটিপ বৃষ্টি । ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে চেতনার লোম ।  মানুষ এমন একটা প্রাণী যে আগুন জ্বালানোর ভেতর দিয়ে সভ্যতার সূচনা করেছে । আগুনের ওপর তার দখলদারি তে সে আত্মশ্লাঘা বোধ করে । কিন্তু পারে কই ?


ভোলা বলল - এত তাড়াতাড়ি পুড়ে যাচ্ছে কেন ? একজন ঈশ্বর যদি থাকতো  - তাকে খুব ভালোবাসতাম ।
শ্মশানযাত্রী আমরা । এসময় আমাদের ক্ষুধা নেই ,  তৃষ্ণা নেই , ভালোবাসাও নেই ।  শুধু জিজ্ঞাসা কাজ করছে  ।  কেন আমরা মরে যাই ,  কেন আমরা বেঁচে থাকি আর কেনই বা জন্মাই এ ভুবনে ?
উত্তর দেওয়ার দায় নেই আগুনের ।  দুমড়ে মুচড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা শিরদাঁড়াকে সে শুধুই পোড়ায় । ছাই করে দেয় ।


ভাবনাটাকে দীর্ঘ করার জন্য  ' ভুবন ' শব্দের বানান ' ভূবণ ' লিখে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ ।  চোখে দেখি, কানে দেখি, ত্বকে দেখি, নাকেও দেখি । সব মিলিয়ে মিশিয়ে ঠাকুর্দার চোখ । কিন্তু ভেতরে এক অব্যক্ত বোধ জন্মায় । তা মোটেই চিত্রকল্প নয় । অথচ একটি প্রেমের কবিতা লিখতে চেয়েছি আজীবন ।  হচ্ছে না হচ্ছে না কিছুতেই  -


হে বিশ্বরূপ , আমি আপনাকে বহু বাহু,  বহু উদর , বহু মুখ ও অনেক নয়ন বিশিষ্ট দেখিতেছি বটে,  কিন্তু আপনার অন্ত মধ্য অথবা আদি কিছুই দেখিতে পাইতেছি না ।


এর পরেই  নিসর্গ শব্দটা আসে । ঝিঁঝিঁডাক বাড়তে থাকে ।  তখন শুধু নীল কিংবা সবুজ মেটাফোর  - সবুজ রঙের গাছ - ধূসর রঙের আলো , নীল আকাশ ঈষৎ ঝুঁকে ছুঁয়ে থাকে নীল জল । শেয়াল দরজার জুতো নিয়ে  পালায় , শকুনেরা ভেজা গামছায় ঠোঁট মুছে , গাছের ডালে কুচকুচে কালো কাকের ডাক তো আছেই  - কিন্তু জল কাদায় ভুলে যাই গ্রিন হাউস ইফেক্ট ।

বিমলদা গুম হয়ে বসে থাকে ।  হঠাৎ চোখ মেলে বলে - আচ্ছা রাজলক্ষ্মীর সাথে ইন্দ্রনাথের আলাপ নেই কেন ?


কিছুদিন পাউরুটি প্রিয় পিঁপড়েরা মুড়ির গন্ধ পাচ্ছিল না । তারা সাপ খেতে শুরু করেছিল। সাথে আরশোলা ব্যাঙ প্রভৃতি । ফলস্বরূপ  বেড়েছে সাইক্রিয়াটিস্ট । সে কারণেই  কিছুই মনে করতে পারছে না । না নদীর নাম, না ফুলের রং । কেবল এক বিবর্ণ ছত্রাকে ঢেকে যাচ্ছে শরীর।  বুকে সবুজ রঙের ট্যাটু । আহা কী ব্যঞ্জনা !  মানুষ নির্মিত সৌন্দর্যই তাঁর আরাধ্য বিষয় , প্রকৃতি নয়। প্রিয়ার সুন্দর মুখের ভেতর কুৎসিত কঙ্কালের উপস্থিতিও তিনি দেখে নিচ্ছেন। বুদ্ধির কোমল কেন্দ্রে তিনি মাখছেন মেধার লোশন । নক্ষত্ররা হাসছেন মিটমিট ।

রাস্তায় চলাচল বাড়ছে । উপেক্ষা করছি পড়ার ঘর । ধ্যানস্থ বুদ্ধকে সর্বভুক উইপোকা কুরে খায় । বেরিয়ে পড়ে ফাটলের জ্যামিতিক চিত্র ।  হাঁফ ধরে বাতাসের । এটাই সুনিশ্চিত।

জ্বর আসে । জ্বর বলি না আর  - বলি গায়ের তাপ । সহ্য করছি পার্থেনিয়ামের সংক্রমণ ।  ঘনঘোর অন্ধকার সহ্য করতে শিখে যাচ্ছি ।  শিখে যাচ্ছি হাড়ের ক্ষয়  - পক্ষাঘাত ।

কবি নিতাই মাইতির কবিতা পড়ছি  - ' কেউ কাউকে বুঝে উঠতে পারিনি  / রাস্তার দুপাশে দু' জন / শতাব্দী সেরা বট ও অশ্বত্থ  '।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন