কবিতা-- জগজ্জননী
সৌরভ ঘোষ
"দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি পরং সুখং
রূপম দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো দেহি
বিদেহি দেবী কল্যাণাং বিদেহি বিপুলাং শ্রিয়ম
রূপম দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো দেহি"
মেয়েটা আগের বছর জগজ্জননী সেজেছিল,পাড়ার নাটকে
লাল পাড় সাদা পাটের শাড়ি, আলতা মাখা পা,
একটা হাতের চেটো আশীর্বাদের জন্য তুলে ধরেছিল
আর একটা ছিল মাটির দিকে,সৌভাগ্য ঝরছিল
চোখে অপার মায়া,হাসিতে বিশ্বশান্তির কুসুম ছায়া
মেয়েটা দশম শ্রেনী
মেয়েটা রোজ ভোরে ওঠে,
বাবার জন্যে শাক তোলে
কাঠ কুড়িয়ে রান্না করে,
তারপর স্কুল,এক মাইল দূরে...
দশভূজার মত একা হাতে সবদিক সামলায়
মদ্যপ বাবা রোজ টলতে টলতে ফেরে,
মা, আগেই মায়াডোর ছিন্ন করেছে
এখন পুব আকাশে সুতিশুভ্র শুকতারার বেশে
প্রতিদিন ভাত না জুটলেও, মার ঠিকই জোটে,
সব কিছুর মতই রপ্ত হয়ে গেছে
ক্লাস সিক্স থেকে...
ভয় হয়, দরজার পাশে চ্যালাকাঠটা দেখে
পিঠের থেকেও বেশি আঁচড় জর বস্তুর গায়ে,
কি ভেবে যেন তুলে রেখেছে।
বাবার মার তবুও সহ্য করা যায়
রাস্তার মোড়ের বেহায়া ছেলেগুলো বড্ড জ্বালায়,
টোন করে "এই মাতালের মেয়ে"
ষোড়শী, ঠোঁটে ওড়না চেপে পা চালিয়ে হাঁটে
কালা হলে ভালো হত,এত অপমান!
যেদিন নিলু গায়ে হাত দিল বন্ধুত্বের অজুহাতে
চর কষিয়ে ছিল জোরে
নিলুও বলে গেছে" বদলা নেবে"
"কেন মেয়ে হলাম?তুমি কি অন্ধ, দেখেও দেখো না?
আমি তো প্রতিদিন সন্ধ্যেয় ধূপ জ্বালাই,
তাহলে তুমি কাদের ডাকে সাড়া দাও?"
নিঃসাড় ঈশ্বর,দুর্বলদের ডাকে সাড়া দেয় না,
মেয়েটা এখনও জানে না।
ঘরে বাইরে লড়তে লড়তে ক্লান্ত মেয়ে...
রমেশ দাদু ও'কে জগজ্জননী বলেই ডাকে।
দশমীর রাত,
আশ্বিনের ঝড় আছড়ে পড়েছিল মেয়েটির জীর্ণ কাঠামোয়।
সে'রাতে বাবা মদ খেয়েছিল অনেকটা,বিলিতি মনেহয়
বন্ধুর কাঁধ ভর দিয়ে টলতে টলতে
একচালার ঘরে,খোলার চাল মাটির দোর,
বাইরে চাঁদ , ঘরময় কুৎসিত গন্ধ আর ঘোর অন্ধকার...
বন্ধুবেশী শয়তান
নিদ্রিত শিশুর মত মাথায় হাত বুলিয়ে
উপদেশ দেয় সদ্য যৌবনাকে
সুযোগে হাত চলে যায় মেয়েটির পেলব বুকে
বন্ধুবেশী হায়না জানে ফূর্তি কি,পিপাসার মানে
প্রবল বাহু দুর্বলাকে জোর করে টানে...
মেয়েটি তখন দৌড়বাজ
রক্তশূণ্য দেহে আকস্মিক বজ্রপাত,
বিষাক্ত কামড় বসায় হায়নার থাবায়
বাবা তখনও অচেতন,বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ে-
নখের আঁচড়ে ফালা ফালা করে দিতে চায় পৃথিবী,সৃষ্টি
অভুক্ত মেয়েটি ছিটকে আসে ,চাঁদের নীচে...
বাবার বয়সী লোক,"ছিঃ"
এরাও মানুষ!
মেয়েটি,সেইরাতে প্রথম বুঝল পুরুষ মানে ভয়,
প্রথম বুঝল অন্ধকার কতটা নির্দয়।
শুকতারা তখনো মাঝ আকাশ
লোভী নেকড়ের জিভের গরল অন্ধকারেও চকচক করে
জান্তব ইশারায় কাছে ডাকে,যুগের সভ্যতাকে...
বারোয়ারিতলায় ঢাকের আওয়াজ তখনও থামেনি,
মনে হয়,'মা' জলে পড়ার সময় হলো ,
তবে কি নিজেও...
নিচুগলায় বিবেক গর্জে ওঠে "কক্ষনো না,
মা বলেছিল -"লড়তে হবে,
মেয়েদের প্রতি মুহূর্তে লড়তে হয়,
এটাই সমাজের নিয়ম..."
নক্ষত্রের অভাবে মেয়েটি নিজেই জ্বলে ওঠে
কোমড়ে ওড়না বাঁধে, হাতে নেয় চ্যালাকাঠ
আয়তনেত্র থেকে বেরিয়ে আসে দুরাধ্যয় তেজ
যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবে বাঁচার মন্ত্র
খোলা চুল থেকে বিকরিত হয় হাজার সূর্য সমষ্টির আলো,
এলোকেশী রণমূর্তি ধারন করে...
দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক, ঘণ্টাধ্বনি,
অসংখ্য শাঁখের আওয়াজ,মহামন্ত্র
"চন্ডীকে সততং যুদ্ধে জয়ন্তী পাপনাশিনী
অচিন্ত্যরূপ চরিতে সর্বশত্রু বিনাশিনী..."
ঢাকের বিসর্জন বোল আর এক দেবীর আবাহনে মেতে উঠে...
এই মেয়েটি সেই মেয়ে
যে আগের বছর জগজ্জননী সেজেছিল পাড়ার নাটকে
এই মেয়েটি সেই মেয়ে
যে মুখ বুজে সব সহ্য করত ঘরে-বাইরে,হাটে-বাজারে
এই মেয়েটিই সেই মেয়ে
যে ভাগ্যের সাথে আপোষ করেনি,স্বেচ্ছায় অস্ত্র ধরেছে হাতে
এই মেয়েটিই সেই মেয়ে
যে সাহসে আছে, মানসে আছে
এই মেয়েটিই সেই মেয়ে
যে তোমাদের পাশের বাড়িতে থাকে
এই মেয়েটাই সেই মেয়ে
যে তোমাদের মা,তোমাদের বোন,তোমাদেরই মেয়ে
এই মেয়েরাই সেই মেয়ে...তোমরাই সেই মেয়ে
তোমরাই জগজ্জননী...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন