রবিবার, ৩ মার্চ, ২০১৯

পলাশ মজুমদার


কালচিতি

পলাশ মজুমদার


রোদের আঁচলে চুল শুকোচ্ছে বাতাসীর মা। পারুল। এই সময়গুলোতে প্রথম স্বামীর কথা মনে পড়ে আবছা। পারুলের গায়ে পড়া স্বভাব। সদ্য বিয়ে হয়েছে তখন। গাঁয়ের ছেলে - ছোকরাদের সাথে কি ভাব, কি ভাব! ঘরে ডেকে এটা-ওটা খাওয়ায়। হেসে হেসে কথা কয়। অনিলের সহ্য হতো না মোটে।

'বউ তো নয়, কালনাগিনী ঘরে এনেছি বিয়ে করে!' - অনিল আপন মনে বিড় বিড় করতো মাঝে মাঝে। তখন বাতাসী সবে এক। একদিন সকালে অনিল কাজে গিয়েছিলো মাঠে। আলের উপর শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলো এক কালচিতি। লক্ষ্য করেনি অনিল। লেজের উপর পা পড়তেই কেল্লা ফতে। মুখ থেকে অনেকটা গ্যাঁজলা উঠেছিল। জানাজানি হতে গাঁয়ের লোক ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল। উপেন ডাক্তার অনেকক্ষণ নাড়ি টিপে টিপে জবাব দিয়ে যান।

কিছুদিন বোবা হয়ে গেছিলো পারুল। দিন ফুরোলে মিইয়ে যায় বিগত। ঝাপসা হয়ে আসে বেদনার রং। শোক বৃদ্ধ হলে ঝিমিয়ে পড়ে। খোসার আড়ালে উশখুশ করে কবেকার খিদে। ওৎ পেতে বসে থাকা পুনর্জীবন খিলখিলিয়ে হাসে। সেই উৎসবে পারুলকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল মুকুন্দ। তারপর পাশের গাঁয়ে ঘর বেঁধেছে। বাতাসী তখন দুই। এখন আঠেরো।

পুকুরে জাল ফেলে গোটা দুই চিতল ধরেছে বাতাসীর সৎ বাপ। আজ ছিল হাটবার। সকালে রথতলার হাট থেকে বটিতে ধার দিয়ে এনেছে মুকুন্দ। অষ্টাদশী আপনমনে নাড়িভুঁড়ি টেনে বার করছে চিতল মাছের পেট থেকে। বাতাসীর পেটের উপরের দিকটায় একটা কালশিটে কামড়ের দাগ আছে। গতবার দোলে অষ্টপ্রহর বসেছিল গাঁয়ের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে। পাল বাড়ির জামাই-মেয়েও এসেছিলো।

পালের মেয়ে কীর্তন ভালোবাসে। এক খিলি জর্দা পান মুখে পুরে আসরের সামনেই বসেছিলো সে। নদীয়া থেকে দল এসেছে গাইতে। যে ছেলেটি বাঁশি বাজায়, কয়েকবার চোখাচোখি হয় দুজনার। ওর বাঁশিতে জাদু আছে। খোল, করতালের কলরব এড়িয়ে পালের মেয়ে রাতভর মজে থাকে চোখের মায়ায়, সুরের জাদুতে।

জাদু জানে পালের জামাই। হাতে আগুন। চোখে মন্থনের ডাক। মাঝরাতে থিতিয়ে আসে ভীড়। অখন্ড মাদুরে ওরা তখন জনা কয়েক। পাশেই একমনে গান শুনছে বাতাসী। সেই কখন থেকে বুকে জড়ানো রংচটা ওড়নাটা স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে আছে অনাদরে! দিক-বিদিক, ছন্নছাড়া! বাতাসীর তপ্ত বুকে শীতল মায়া। কে কাকে ফুসলেছিলো রাধামাধব জানে!

'বাতাসী আগুন খেলবি? আয়, পেছনের গোয়াল ঘরের পাশে বিচালি রাখা আছে, কোথাও কেউ নেই, তুই আর আমি!' - কথাগুলো কানে কানে বলেই জামাই দাঁড়িয়ে ছিল পেছনে জামরুল গাছের গোড়ায়। ঘুঁটঘুঁটে আন্ধার। পা টিপে টিপে, কাঁপা কাঁপা বুকে বাতাসী এসে দাঁড়ায়। ঠোঁট, চুল ছুঁয়ে দিতেই নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। বাতাসী ছুটে গিয়ে ওৎ পেতে শুয়ে পড়ে শুকনো বিচালি শয্যায়। যেমন করে কালচিতি আরামে রোদ পোহায় আঁলের ওপর।

মন্থন শেষে উঠে দাঁড়ায় জামাই।
'তুই একটু পরে আয় বাতাসী' - একদলা কফ গিলে নিয়ে জামাই হনহন করে হেঁটে যায় আলোর দিকে।

পাতে চিতল মাছের এক টুকরো পেটি আর মাথা। মধ্যাহ্নের আহার সারছে মুকুন্দ। মা-মেয়েতে পরে বসবে। ঘর থেকে ভয়ার্ত গলায় হাঁক পাড়ে বাতাসী,
'মা, ওহ্ মা ঘরে সাপ ঢুকেছে!'
'কি সাপ? কি সাপ?'- রান্নাঘর থেকে সমস্বরে জবাব আসে।

'ধরন - ধারন যা, মনে হয় কালচিতি!'


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন