শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯

উজান উপাধ্যায়



উজান উপাধ্যায়- এর কবিতাগুচ্ছ


হৃদমাঝারে


কবি যদি মুক্ত থাকে, যত্রতত্র হেঁটে যাওয়ার সুযোগ পায় সেটা খুব বিপজ্জনক। যদি খাদের ভিতরে আটকে যায় পা, জলের ভিতর রাখা থাকে লক্ষ লক্ষ সুন্দরী মাছের আঁশের মধ্যে  আত্মগোপন করা চিঠিদের বাদামী হরফ ঠিক তখনই এলোমেলো হবে
রীতি ও রেওয়াজ।মনখারাপের দিন গুলোকেই বর্ষাঋতু ভাবতে হলে শীতের শুষ্ক হাওয়ায় ঠোঁট ফাটলে, বেদনায় ফেটে যাওয়া বুকের পাঁজরে আটকে থাকা মেঘেদের অস্বীকার করে যেতে হয়।

কবি মুক্ত থাকলে লক্ষ লক্ষ নাগরিক বিছানায় কবির জন্য কাঁদবে নারীরা।খুলে ফেলবে রাতপোশাক। নিরাভরণ বুক আর তলপেট এগিয়ে দিয়ে বলবে -লেখো তোমার যা যা বাকি রয়ে গেছে। খবরদার মনখারাপের একটি শব্দ নয়। উড়িয়ে দাও আলোর পাখি আমাদের নাভিবিন্দু থেকে অন্তহীনে।

শপিং মল থেকে  চলে যাওয়ার পরও অসংখ্য মেয়ের ছায়া আটকে থাকে ঝাঁ চকচকে পাথর বা মোজাইক করা মেঝের খোলামেলা ডিজাইনার টাইলসের প্রতিটি শ্বেতবিম্বে। মেয়েরা তো প্রত্যেকেই নদী। যদি পাখিদের এখানে ডাকতে হয়, কবির তো দফারফা।

একজোট হয়ে সমর্পিতা অঙ্গনা রঞ্জাবতী অন্তর্লীনা নৈঋতা আরাধ্যা আর অবন্তী -শাস্তির বন্দোবস্ত করে বলবে-কী চাও কবি বলো, শরীর মন আত্মা বলোতো আমাদের শৈশব যৌবন চাওতো গোপন সব স্নান চাওতো আমাদের ঋতুজ গল্পের প্রতিটি পাতাই খুলে রাখবো তোমার আঙুলে।

মনখারাপ কোরোনা কবি। আগুন জ্বালো লক্ষ জোনাকির ছটফটে আলো জড়ো করে।দাবানল জ্বালো নিষিদ্ধ প্রেমের।

খুলে ফেলো পৃথিবীর সব অপ্রকাশিত ইনবক্স। দেখে নাও কত গুপ্ত ভালোবাসা জমা হয়ে আছে, কত কান্না কোষে কোষে
জমেছে নারীর, কত শোকাহত পুরুষ প্রতারিত হয়ে আছে সঙ্গমের শেষ পর্যায়ে। মানুষের কত অপর্যাপ্ত শোক ও বিষাদ আকন্ঠ মহুয়া গিলেছে  নিঃসাড় হয়ে যেতে যেতে, পাঁজরে জমানো সব নীলঘাস আস্তাবলে রেখে গেছে শিকারি নিশানা আত্মহননের নিঃসঙ্গ আস্ফালনে।

তোমার জন্মদিনে এ বুড়ো গ্রহের কত প্রান্তে বসেছে মঙ্গলঘট, কত মন্দিরে উচ্চারিত হয়েছে কল্যাণের স্তব, আজানের ধ্বনি শোনা গেছে কত মসজিদে, কত গীর্জায় বেজেছে প্রার্থনার স্বর।

ধূপ চন্দন ধানদূর্বা পায়েসের আয়োজনে পৃথিবীর প্রতিটি গুহায় প্রতিটি গৃহের চৌকাঠে আল্পনা এঁকে গেছে নারী, সারারাত জ্বলেছে তারারা, প্রজাপতি শঙ্খচিল গাঙশালিখেরা জেগে জেগে অতৃপ্ত ওষ্ঠভাঁজে সঞ্চয় করে গেছে অপাপবিদ্ধ চুম্বন সারিসারি।

কবি মুক্ত হলে পৃথিবীর সব ঘরবাড়ি নিষিদ্ধ প্রেমের উদাত্ত অলকানন্দা স্রোতে পুরনো গীটারে মাউথঅর্গানে সেতারে ও ভায়োলিনে বাজিয়েছে অবিরাম-

তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবোনা।

কবি মুক্ত হলেই, মনখারাপের ধূসর রঙে পান্ডুলিপি জেগে উঠলেই শীতলক্ষ্যার ওমে কারাগারের স্বরচিত জ্যোৎস্নায় পাঁজকোলা করে আঁকড়ে ধরেছে শত শত নিরাসক্ত তপস্বিনী। বলেছে - তোমাকে ছাড়লে, তোমাকে উড়নচন্ডীর মতো উড়তে দিলে, তোমার ডিফোকাসড চোখের লেন্সে ছাউনির মতো উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রাচীন লন্ঠনের ঝুলকালি মাখা কাঁচ দিয়ে বানানো ভাঙা চশমায় ভ্রমরদের বসতে দিলে লক্ষ লক্ষ রাতবিছানা পারিজাতের গন্ধে ভেসে যাবে, উপচে পড়বে প্রাচীন বৃদ্ধার যোনি নিঃসৃত ফেরোমন, অলীক এক রাসায়নিকের সৌরভে অন্ধ হবে মালঞ্চ বাগানের সব কোমলমতি ফুলেরা।

কবি, বর্ষা এসেছে মানে  আষাঢ় শ্রাবণ নয়। তোমাকে মরতে দেখে পুড়তে দেখে ছাই হতে দেখে কেঁদেছে নারীরা।

খবরদার কবি , মনখারাপ নয়-তোমার জন্য নগ্ন হতে প্রেমিকা হতে হয়না আমাকে, শুধুমাত্র খোলাবুকে একটা আকাশ পেতে রাখা - একটা অন্ধকার ক্যানভাস।

তুমি শুধু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছিঁড়ে ছিঁড়ে তোমার বিদীর্ণ ঠোঁটে অক্ষর কুড়িয়ে কুড়িয়ে এখানে ছড়াও।

ভালোবাসা কাকে বলে জানতে হবে না, শুধু বৃষ্টি এনে দাও।
কবি মুক্ত হলে ভূগোল পড়ানো দরকারই হবে না আর, ঋতুরঙ্গ নটরাজ সবাই খারিজ।

নারীদের রাতপোশাক মহাকাশে ছুঁড়ে দিলে ভালোবাসা ঘুঙুরের মতো নেচে নেচে কবিকে জোগাবে সুখ, কবির শুধুই একটি কাজ-

সারাও এ পরবাসে প্রতিটি অসুখ।



মেয়েদের হাতে

উজান উপাধ্যায়


বুঝে শুনেই গাছের সাথে সংসার বাঁধল মেয়েটি ।
রাত্রি হলেই মেয়ে গাছ হয়ে যায় ।
ছোট থেকেই এমন ....
মেয়েটি বুঝেছে অন্তত রাতে কোন পুরুষ তাকে ঘেন্না করবে না ।
অবিশ্রান্ত স্নান পেতে গেলে ফুলশয্যা
গাছের সাথেই , অন্তত কিছু গাছ যতদিন ফুলের জন্ম দিতে থাকবে অভ্রান্ত ভ্রুণাধারে ।

ভূমিক্ষয় রুখে দিতে মেয়েদের সামনে আর যে কোন পথই খোলা থাকছে না।




পলিমাটি

উজান উপাধ্যায়


তোমার বুকের দেড় ইঞ্চি গভীরে নামলেই আমি ঘুমিয়ে যাই , অসাড় মৃত মাছের মত লবণাক্ত ঢেউ দুহাতে সরিয়ে।

তোমার কান্নায় আমার দেহদান।

ঝুরঝুর করে স্মৃতিভস্ম ছড়িয়ে যায়
অন্ধকারে মিশে থাকা ছোবলের আর্তনাদ-চিহ্নের
শিকারি উষ্ণতায় ।

তুমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছোনা
আমার হরিণছুট , আমার নিঃশ্বাসে একশো আট গাছের রিক্তস্বর , ভিজে চুলে প্রতারক  হরিণীর গা ঘিনঘিনে ঋতুস্রাব।

তুমি মরণপণ  ফিরিয়ে আনতে চাইছো তোমার দশ আঙুলে , আমার অসহায় তীক্ষ্ণচূড়া জলাধারের আনত উত্থান
তোমার দলাপাকানো বর্ষবলয়ের প্রতিটি আবর্তে পাক খেয়ে উঠছে জলস্তম্ভের আসঞ্জিত মৃত্যু বিন্যাস।

একটার পর একটা চামড়া খসিয়ে নেমে আসছি অরক্ষিত  আস্তাবলের অশান্ত শিবিরে ।

প্রতিটি চুম্বনেই অন্য কোনও ঠোঁট বুঝছো  ,  ভাবছো প্রতিটি ঘামবিন্দু ভুলের ছদ্মবেশে এখনো
হন্তারক , বিষমদে তলিয়ে যাওয়া পাহাড়ের আতঙ্কিত চন্দনস্নান , ধূপগন্ধে মৃত জোছনার নিথর উল্লাস।

তুমি ক্রমাগত ভেঙেচুরে মন্থন শেষেও নদীপাড়ে পৌঁছোতে পারছো না।

কিছুতেই বোঝাতে পারছিনা , তোমার শরীরের প্রতিটি কার্নিশে , প্রতিটি খাদে ও খাড়িতে গুছিয়ে রাখা পরাজিত লাশে তোমার অক্ষরমালার প্রতিটি বীজ রোপণ করছি নিরুপায় প্রেমিকের গত্যন্তরহীন
অবশিষ্ট যুদ্ধের মতো।

এইবার বলে দিই , শোনো-

ভালোবাসায় বিশ্বাস ফিরতে তোমার যতটুকু সময় লাগবে , ততদিন ভাগচাষীর মতো  তোমার নাভির চারপাশে আবহমানের সমস্ত পলিমাটি স্তরে স্তরে জমিয়ে যাবো।

কথা দাও শুধু এইটুকু -

প্রবল বৃষ্টি এলে নিঃস্ব আমাকে জলসেচে পৌঁছে দেবে তোমার শৈশবের প্রতিটি প্রত্যাখ্যাত উপত্যকার নিরস্ত্র অরণ্যের শিশির-শিকড়ে।

ভালোবাসা বারবার মরে , তবুও যে ভালোবাসা অজেয় অমর , প্রেমিকার নিহত কোমরে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন