মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

দেবাশিস বসু


স্বপ্নে ছবির বর্ণমালা

দেবাশিস বসু


পুবের আকাশে লালিমা লাগে
ঘুম নামে রাতের চোখে
স্তিমিত আলোয় পাখীদের ভৈরবীতে
ঘুমন্ত শহরটা ধীরে ধীরে জাগে
গাছের পাতায় লাগে বাতাসের দোলা
এতো সুন্দর ভোরটা নিরাশ করে না
তোমরা যখন কাল রাতের মহোৎসবে
আমিও শরিক তোমাদের আনন্দের
গতকাল ফেলে দেওয়া বর্জ্যের মধ্যেই
পেয়েছি আজকের সম্পদ-স্বপ্ন ভবিষ্যতের

অবনত শরীরে বিশাল চটের থলে পিঠে
বাম কাঁধ ঝুঁকে থাকে সমুখপানে
সময় শরীরে রেখে গেছে সহস্র ক্ষতচিহ্ন
অশক্ত শরীর ভর রাখে লাঠিতে
ঐ লম্বা লাঠিটাই আমার তৃতীয় পদ-
কাঙারুর মতো লাফিয়ে চলার সম্বল
ঐ লাঠিতেই আমি খুঁজি আবর্জনার স্তূপ
চোখজোড়া রাতের শ্বাপদের মতো উজ্জ্বল
খুঁজে বেড়াই ফেলে দেওয়া নুপুরের ঘন্টা
ভাঙা বোতল বা প্লাস্টিকের পাখা
কিংবা কবন্ধ পুতুল-কনিষ্কের মতো
একসময় সূর্যের তীব্র দাবদাহ
দাবদাহ জঠরে-জ্বলন ফুসফুস ভরা বিষে
সারাটা মুখ জুড়ে ময়লার আস্তরণ
ভ্যান গখের ছবির মতো রঙিন
কনুই অবধি পুরোটা হাত
সারমেয়র আকাশভেদী চিৎকার
গর্জন শান্তিরক্ষকের-তিরস্কারে পুরপিতা
সমাজসেবীর দেওয়া 'ছেলেধরা' তকমায়
আমি তো সমাজহীন-প্রান্তিক আবর্জনা
সভায় মিথ‍্যেই বলেছিল 'পরিবেশ বন্ধু'-
মন্ত্রীর ঘোষণায় নাকি দেড়লাখী ইনাম

যখন পশ্চিম দিগন্তে
সন্ধ্যা হামাগুড়ি দিয়ে আসে
ক্লান্ত শরীর কবেকার শীর্ণ গলিতে
ঝুপড়ির ছাদগুলোর সদম্ভ প্রকাশ-
আকাশের অনেকটা অংশ তাদের দখলে
দড়িতে ঝোলে হরিশা' হাটের যাবতীয় পণ্য
সময়ের টানাপোড়েনে তারাও শতচ্ছিন্ন
গলির বুক চিরে ছুটে চলে
অদম্য ঝর্ণাধারা-পুতিগন্ধময় স্রোতস্বিনী
অর্ধনগ্ন শিশুর দল আলোআঁধারীতে
আমি যেন এক ছদ্মবেশী যোদ্ধা-
যুদ্ধজয় করে ফিরেছি সদ্য
শিশুরা ছুটে আসে
সান্তা কি নিয়ে এসেছে দেখবে বলে
ছেঁড়া পকেটের একটা সিকি বা আধুলি
দু'হাজারী নোটের চেয়েও দামী বেশি

থলেটা উপুড় হয়-ঝুপড়িতে
হুড়মুড় করে পড়ে যত রত্নসম্ভার
ধাতুর টুকরো প্লাস্টিক কাঁচ বা কাগজ
জহুরীর পরখ প্রতিটি মণিমুক্তায়
তারিফ তাদের আকৃতি আর অবয়বে
দরদামে পাইকার-জোটে দিনান্তের আহার

নিশুতি রাতে দুদ্দাড় মহাপ্রলয়-
সৃষ্টিপূর্বের নৈরাজ্যে
পরম ব্রহ্ম গভীর নিদ্রায়
বুলডোজারে গুঁড়োয় ঝুপড়ির মানচিত্র
শপিং মল হবে যেথায়
লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত মস্তক-
রক্তাক্ত তিলতিল করে জমানো সঞ্চয়
চিৎ হয়ে পড়ে থাকা দলিত অবয়ব-
ওপরে অন্ধকার আকাশ
যেখানে একটু আগেই ছিল
দরমার বেড়া হোগলার ছাদ
অন্ধকারকে আরো নিবিড় করে
আসে শিশুর দল-সঙ্গী তারাদের নিয়ে

এই কি সেই মহান স্বাধীনতা
এর জন্যেই কি অগুণতি বলিদান
ফাঁসির দড়ি দ্বীপান্তর নির্বাসন
পড়ে আছে শুধু পাশবিক বাসনা জঠরে
ক্ষুধা কামড়ায়-আঁচড়ায়-শরীর ক্ষতবিক্ষত
ক্ষুধা এক দাবানল-জ্বালিয়ে পুড়িয়ে
ছারখার করে দেয় যত প্রেম-যত স্বপ্ন
বাহাত্তরটা বছর পরেও
স্বপ্ন দেখি এক জোড়া নতুন জুতোর
স্বপ্নে দেখতে পাই
একটি শতচ্ছিন্ন ছবির বর্ণমালা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন