দ্বিতীয় ভাগ : বিদ্যাসাগরের মূর্তির ভগ্নদশা,,,,
শিশুদের হাতেখড়ি পাঠ "বর্ণপরিচয়" এ ভাঙন
দুষ্টের শাসন নৈরাচার আর শিষ্টের দমন,,,,
আমাদের প্রগতিশীল সমাজে উচ্চবিত্ত হবার প্রলোভনে অর্থের জোয়ারে গা ভাসাতে গিয়ে নগ্নচূড়ায় হিম আশঙ্কার তাই অনেকটাই বিদ্যা পঙ্গু হয়ে যায় অর্থের অভাবে,,, অনেকসময় অভাব এনে দেয় অনিচ্ছা ও অনাসক্তি তাই ভাতের থালায় ভাত বেশী জঠরকে স্বস্তি দেয় বিদ্যালয়ে দিবারাত্র ঝুলতে থাকা কালো ব্লাকবোর্ডে খড়ির লেখনী শুভ্র শব্দগুচ্ছ এর থেকেও। তাই হয়ত বিদ্যাসাগরের মাথা ভেঙে পড়েছে লজ্জায় ও ঘৃণায় এক পিতা হিসাবে যে অক্ষম জীবনের পাঠ শেখাতে তার সন্তানকে কিংবা সুশিক্ষা দিয়ে তাকে মানুষের মতন মানুষ করে তুলতে,,,, কিংবা অর্থ ও প্রতিপত্তির ক্রমাগত লেহনে শিক্ষার কোনঠাসা হওয়া তে,,,
আবার অনেকসময় পোয়াতি মাতৃজঠরে শায়িত ক্ষুদে শৈশব ভূমিষ্ঠ হতে না হতেই হুমড়ি খেয়ে তাকে পিতামাতার ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তির অশ্বদৌড়,,, তারা বর্ণপরিচয়ের থেকে ইংরাজী বর্ণমালা A for apple and B for ball,,, একেক গরাসে মুখে তুলে দিতে বেশী পছন্দ করে রুগ্ন স্বাস্থ্য এ,,, তাই হয়ত অনেকটাই বাংলা হীনম্মন্যতায় ভুগে কঠিন জরা ও অবসাদের চাপে আজ অনেকটাই পদদলিত তাই দেখে সঙ্কোচনশীলতায় বিদ্যাসাগরের মাথা ফেটে চৌচির হয়েছে,,, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই,,, অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে হতে,,, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই,,,,
(( বর্ণ পরিচয়ের আত্মবিশ্লেষণ )),,,,
((বিদ্যাসাগর স্মৃতি গ্রন্থ থেকে বিদ্যাসাগরের চরিত্রের বিভিন্ন দিক সংগৃহীত,,,))
অ---- অ এ অজগর আসছে তেড়ে,,,,,
(( এক কঠোর কঙ্কালবিশিষ্ট উগ্র পুরুষকার যা কখনো ভাঙে নি,,, নোয়াতে পারেনি,,,, সেই উন্নত মস্তক যা কখনও বিশাল ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের নিকট অবনত হয়নি,,,, সেই উৎকট বেগবতী ইচ্ছা যা সকল প্রকার কপটাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে,,,, তার এই দুর্ধর্ষ স্বত্তার উদাহরণ হয়ত তাদের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে যারা কঠোর জীবনদ্বন্দ্বে লিপ্ত থেকে দু ঘা দিতে জানে আবার দু ঘা খেতেও জানে।
কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা তুলির দুধ চুমুক দিয়ে পান করে আর সেই দুধ মাখন তুলে জল মিশিয়ে নেয় তাদের মধ্যে এই উদাহরণ সত্যিই গভীর আলোচনার বিষয়।
সেখানে এই বিভীষিকা উগ্র জাতীয়তাবাদী হুংকারের করালগ্রাসে এগিয়ে আসছে সেই মনুষ্যরূপী অজগর,,,, ধাওয়া করে আসছে ঠিক এইদিকে এগিয়ে,,, এক মহান মনুষ্যত্বের শির খন্ডন করে তাকে স্বার্থান্বেষী ক্ষুধায় গোগ্রাসে গিলে খেতে,,,,))
আ-----আ এ আমটি খাবো পেড়ে,,,,
(( নির্লোভ এক পৌরুষ স্বত্তা,,, একসময় ছোলা বাতাসা জলপান করে পাঠশিক্ষা করতেন,,, তিনি অকুতোভয়ে চাকরী ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন জীবিকা অবলম্বন করে জীবনের মধ্যপথে স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপন করেছেন,,,,
এক অখন্ড পৌরুষ যিনি তাপিত কে ছায়া এবং ক্ষুধিত কে ফলদান করতেন কিন্তু আমাদের শতসহস্র ক্ষণজীবী সভাসমিতির ঝিল্লিঝংকার হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিলেন।
সেখানে এই স্বার্থান্বেষী সমাজ শুধু নিজেরটাই আগে বোঝে,,, আর উপযুক্ত মিষ্টি ফলকে হাতের মুঠোয় আনতে মিথ্যাচারের মিষ্টি কথায় দিন কে রাত আর রাত কে দিন
করে,,, কাজের আগেই আ এ আমটি উঁচু ডাল থেকে পেড়ে খেতে চায়))
ই---- ই এ ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে,,,,,
(( রোগের বীভৎস মলিনতা তাকে কখনো রোগীর নিকট থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়নি। তার কারুণ্যের মধ্যে পৌরুষ ও ঋজুতা লক্ষ্য করা যায় যা তাকে কখনো কুন্ঠিত করে নি।
রবি ঠাকুরের ভাষায় গিরিশৃঙ্গের দেবদারু গাছ যেমন শুষ্ক শিলাস্তরের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে প্রাণঘাতক হিমানী বৃষ্টি শিরোধার্য করে, নিজের আভ্যন্তরীণ কঠিন শক্তি দ্বারা প্রচুর সরস শাখাপল্লব বিস্তার করে সরল মহিমায় অভ্রভেদী করে তোলে,,,, ঠিক সেরকম হলেন বিদ্যাসাগর,,,,
ইঁদুর ছানা হয়ে থাকা শুধুমাত্র জাতির নামে কলঙ্ক,,, আর অনেকক্ষেত্রে অজ্ঞানতা যেটা শুধু শিক্ষা থেকে নয় আত্মস্থ উপলব্ধি থেকে দূর হয়,,, তার সত্যিকারেই খুব অভাব,,, তাই অন্ধকার সদাই এগিয়ে আসে দুর্বলতা হয়ে তাকে গ্রাস করে নিতে))
ঈ--ঈ এ ঈগল পাখি পাছে ধরে
উ--- উ এ উট চলেছে মুখটি তুলে,,,,,
(( বিদ্যাসাগরের চরিত্রের সর্বপ্রধান গুণ তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালী জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করে একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করে ---- হিন্দুত্বের দিকে নয়, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নয়, করুণায় অশ্রুপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্ব এর অভিমুখে নিজের দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে নিয়ে গেছেন,,,, নিজ লক্ষ্যে স্থির থেকে,,,,,
এইভাবে উন্নতশির চির শৌর্যে পৌরুষ স্বত্তা হয়ে এগিয়ে চলতে একাগ্রচিত্তে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে,,,,,মরুভূমিতে জল,,, ছাড়া বেঁচে,,,এক উটের মতন ,,,সত্যিই দুর্লভ চির মলিন এই জাগতিক ছলে,,,))
ঊ--- ঊ এ ঊষা যেন দীঘির পাড়ে,,,,
(( ঈশ্বরচন্দ্র মোটেই সুবোধ বালক ছিলেন না। তার মত দুর্দান্ত ছেলের উৎপত্তি হলে বাঙালী জাতির শীর্ণ চরিত্রের অপবাদ ঘুচে যেত।
সেই ঊষা আবার কবে যে উদয় হবে ঐ জনসমুদ্র স্বার্থান্বেষী কোলাহল ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের আত্মহনন দীঘির কোলে,,, সত্যিই তার আশা এখন অনিশ্চিত সত্য))
এ--এ এ এক্কা গাড়ি ঐ ছুটছে,,,,
(( প্রগতিশীল অর্থ ও প্রতিপত্তির আতিশয্য এ অন্ধত্ব গ্রাস করেছে ঐ উন্নত নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি যা এখন এক জটিল ধাঁধা,,, শুধু দিশাহীন হয়ে সকলে ছুটে চলেছে হন্যে হয়ে,,, ছুটতেই থেকেছে,,, কে জানে কবে সত্যিকারের বেঁচে উঠার দিশা পায়))
ঐ-- ঐ এ ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে,,,,
(( বিদ্যাসাগর একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন,,, তার গ্রামে তখন পাশ্চাত্য শিক্ষার তেমন একটা প্রভাব ছিল না,,, কিন্তু পরে তিনি নিজে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও দীক্ষায় অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু তাকে অনুকরণ করার মত অনেক কিছুই ছিল সেটাতে তার চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি। কারণ তার আগেই তার চরিত্র সমগ্রভাবে সম্পূর্ণরূপে গঠিত হয়েছিল,,,
ঐ দেখো ঝাঁ চকচকে আধুনিক উন্নত শিক্ষা পাশ্চাত্য সমাজ ও তার প্রগতিশীল ধারণা,,, তাই ঐটা মানে চাঁদকে হাতের মুঠোয় করতে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে নিজের অস্তিত্বকে মাতৃভূমির মাটি যেন এক লহমায় শেকড় উচ্ছেদের প্রতীক্ষায় ,,, চলো চলো লেগে পড়ি আধুনিক ভাবে নিজেকে পাল্টে গড়ে নিতে পাশ্চাত্য শিক্ষায়,,, ))
ও--ও এ ওল খেওনা ধরবে গলা,,,,,
(( কঠোর সংগ্রামী জীবন যাপন করে মাত্র সত্তর বছর বয়সে ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর মারা যান। পৃথিবী তে এমন লোক খুব কমই জন্মেছেন। একথা বলা যেতে পারে যদি বিদ্যাসাগর কোন ইউরোপীয় দেশে জন্মাতেন তবে ইংলন্ডে নেলসনের যেমন স্মারক বানানো হয়েছে,,, সেইরকম স্মারক ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও স্থাপিত হতো। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের স্মারক আজ বাংলার ছোট অথবা বড়, গরীব অথবা আমীর, সব লোকের হৃদয়ে স্থাপিত,,,
এইভাবে প্রতি মরণশীল ব্যক্তিস্বত্তা অমর হয়ে থাকতে চায় তার খুব সাধ,,,সকল ঐশ্বর্য ও স্থপতির একচ্ছত্র অধিকার পাওয়া,,, তাই নানা আত্মভোগী নৈরাজ্য এ করে দাপাদাপি,,,শুধু বৈষম্যে দলাদলি হিংসা আর অরাজকতা,,,কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র যার প্রখর অনাসক্তি এই সকল কিছুর প্রতি,,,, যেন ওল খেওনা ধরবে গলা,,, তার শুধু করে যাওয়াই ছিল একমাত্র ভোগ,,, মনুষ্য সমাজের ভোগান্তি অপসারণ তার একমাত্র উদ্দেশ্য))
ঔ--ঔ এ ঔষধ খেতে মিছে বলা,,,,,,
(( এই যে বাঙালীত্ব নিয়ে আমরা যে অহোরাত্র আন্দোলন করি তা অতি ক্ষুদ্র ও শীর্ণ কলেবর ধারণ করে তার সামনে।
বিদ্যাসাগরের উন্নত চরিত্রের যা মেরুদন্ড যেটা তার সামর্থ্য ও আত্মনির্ভর শক্তির পরিচয় বহন করে তার পরিচয় বাঙালী জাতির মধ্যে সত্যিই বিরল।
এখন প্রত্যেকেই প্রায় সংকোচনশীল অন্তরস্বত্তায় অঙ্গুরীমাল পর্বের কোন কেঁচো সর্বদাই মেরুদন্ড ভাঙা হামাগুড়ি দিয়ে চলে মাটিতে শীর্ণ দেহ ঘষে ঘষে,,, সেখানে ঔষধ খেয়ে যে সে সুস্থ নাগরিক মনুষ্যত্বে বেগবতী প্রকট ইচ্ছায় মাথা তুলে দাঁড়াবে,,, সেটা সত্যিই এক অবাক করা সত্য,,,,তাই ঔষধ খেতে মিছে বলা,,,,))
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন