নারী কী আমি জানি না
অজিত রায়
.............................
সেক্স একটা অর্গানিক ট্রুথ। আহার, নিদ্রা আর মলসাধনের মতই নিখাদ শরীরচর্চা। কিন্তু কপুলেশন বা মৈথুন বা তসলিমার দি গ্রেট সরাফমামু যারে কয়েছেন 'ড্যাস-ড্যাস', সেটি ভদ্দরপুঞ্জে সহজ উচ্চারণ নয়। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অ্যাসটোনিশমেন্ট আর ভ্যাজাইনাল সেন্সিবিলিটি। যে কারণে এত জরুরি একটা কাজ আমাদের অন্যান্য জৈবিক কারবার থেকে বেপোট হয়ে গ্যাছে। এটা ওই ভদ্দরপুঞ্জের টুলোদের কারসাজি। ওরাই সামাজিক ট্যাবু ম্যানুফ্যাকচার করেছে। শ্লীল-অশ্লীলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিয়েছে কোঁদল। ওই কোঁদল আর তার অ্যাডহিরিং লুকোচাপার দরুন এদেশের ফিল্ম এবং সাহিত্যেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, যৌনতা দেখানো হয় পারভার্টেডলি। বলতে পারো, যৌন বর্ণনা বা ছায়াকরণের ক্ষেত্রে মোটামুটি পর্নোগ্রাফিকেই উল্টো ছাঁদে সার্ভ করে আসছেন এ দেশের বেশি ভাগ রাইটার-ডিরেক্টররা।
আমার সমস্ত উপন্যাসেই 'নারী' পুরুষের ইন্টেলেক্ট থেকে আঁকা। কিন্তু একজন বখাটে খানাখারাব হলে কি নারীদেহের মহার্ঘ পার্টসগুলোকে আমি অন্য চোখে দেখতাম? হয়ত, একদমই না। এ ব্যাপারে ভদ্দরলোক বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা। মাথার শিরোজ থেকে গোড়ের পদরজ, একটা হোলদামড়ি নারীর কী-ই না ভাল্লাগতো কালিদাসের! তবে আমার-মতো উনি কতখানি সাধুলোক ছিলেন, খটকা আছে। সাধুমণ্ডলে নারীর অষ্টোত্তর শতনাম। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী ----- এসব তো মানুষের নিজস্ব এলেমে হয়নি, খোদ বিশ্বকর্তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন। ফের এদের মধ্যে শঙ্খিনী আর পদ্মিনী হলো 'আইটেম' বিশেষ। তেনার 'অন্তিমের মার'ও বলতে পারো। একা তুমি কেন, বাইবেলেও বলেছে, নারীই বিধাতার শেষ সৃষ্টি। 'হে শুভদর্শনা', অশোক ফরেস্টে সীতাকে দেখে রাবণ কেলিয়ে গিয়ে বলছেন, 'আমার মনে হয় রূপকর্তা বিশ্বনির্মাতা তোমায় রচনা করেই নিবৃত্ত হয়েছেন, তাই তোমার রূপের আর উপমা নেই।' অথবা, ঈভার প্রতি মিল্টন : 'ও ফেয়ারেস্ট অফ ক্রিয়েশন, লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট / অফ অল গড'স ওয়র্কস'।
বাংলা সাহিত্যেও নারীর উপমা যে একেবারেই নেই, সেটা বললে বাওয়াল হবে। তবে আমি আমার কথাই বলব। আমি মৃণার বুকে কান পেতে শুনেছি সমুদ্রের কলকল। নারী সমুদ্র ছাড়া আর কী, বলো! হোক নোনা। কিন্তু নোনা থেকেই লোনা। লোনা থেকে লবণ। লবণ থেকে লাবণ্য। কত নুন খেয়েছো মৃণা! সব নুন কি তোমার দেহে? আর খেয়ো না। এতে সৌন্দর্য হারায়। অবিকগুলি খসে-খসে সহসা খোয়ায়।
সত্যি, এক বিশাল মহাযোনি পয়োধি এই নারী। আর পুরুষ কেসটা হলো, অই উষ্ণু মাংসল অলীক পাথার-কিনারে বাল্বের ছেঁড়া ফিলামেন্টের মতো অধীর কাঁপুনি সহ দাঁড়িয়ে থাকা পৌনে ছ'ফুট লম্বা একটা হাইটেন্ডেড ও ব্যবায়ী পুরুষাঙ্গ মাত্র। মাইরি একটা কথা কী জানো, খুব কৈশোর থেকে একজন পুরুষ তার যৌন-অহংকার নিয়ে তিল-তিল করে গড়ে ওঠে, স্রেফ, একজন নারীকে জয় করবে বলে। কিন্তু সে কি সেই কাঙ্খিত নারীকে পায়! পরিবর্তে যাকে পায়, তারও তল পায় না। কী যে চায় মৃণা, মহা ধাঁধা। একেক সময় মনে হয়, কী যেন খুঁজছে, অবিরত। ওফ, টস করেও বোঝা দায় এই মেয়ে জাতটাকে। একেক সময় খটকা জাগে,নারী এক হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক শিল্প। নারী মৃত্যুর বিজ্ঞান। ডেথোলজি। আচ্ছা, এ নারী কে? এ দিনে এক, রাতে আরেক! এ নারীকে সত্যিই আমি চিনি না। পরিচিত দায়রার যথেচ্ছ-নারীর কাছে কোনোকালেই বিশেষ যাচনা ছিল না আমার। আমি এমন নারী খুঁজিনি যে শুধু ঘুমোতে আগ্রহী বা গামলা-ভরা খাদ্যে। নারীকে নারীর মুখ বা নারীর চোখ মাত্র আলাদা করে চাইনি, কেবলি। চেয়েছি টরসো মূর্ধা সৃক্ক নোলা কল্লা সিনা রাং নিতম্ব পয়োধর নাভি যোনি নবদ্বার সম্বলিত একটি পূর্ণাবয়ব নারী, যাকে স্পর্শ মাত্রের লহমা থেকে শব্দের স্রোত ধেয়ে আসবে বেবাক এবং প্রতিরোধহীন। স্ব-পরিচয়হীনা, জন্মহীনা, ইতিহাসহীনা, নিয়তিহীনা সেরকম কোনও নারী আজও আমার উপজ্ঞার বাইরে রয়ে গেছে। দ্য বেস্ট রিলেশান বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান ইজ দ্যাট অফ দ্য মার্ডারার অ্যান্ড দ্য মার্ডারড। দস্তয়ভস্কির কথাটাই কি তবে মোক্ষম? নারী পুরুষকে হালাল করবে, তার আগেই নারী বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত-সব বাহারি শব্দঘোঁটের বিছেহার জোর করে লাথিয়ে ভেঙে ফেলা দরকার যদ্বারা উদ্ঘাটিত হবে নারীর মৌল স্বরূপ।
নাঃ। নারীকে সঠিক ডিফাইন করতে পারছি না বলে নিজেকে ভীষণ ইরিট্যান্ট লাগছে। কলমের মুখে খাপি এঁটে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। এলইডি-প্লাবিত বিছানার ওপর 'আমার' নিজস্ব নারীর সযত্ন-রক্ষিত দুধে-আলতা ডালপালা। একটা উদ্ভট চেতনা আমার অসংযত মানসিক স্টেটকে পরাভূত করে ক্ষণিকের জন্যে হলেও স্বপ্নে দেখা এক দুর্বোধ্য নারীর দিকে ছুড়ে দিল আমায়। আমি দেখতে পেলাম রানী আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ---- রানী! কমল ছুটে গেল। ছুটছে। কমল ছুটে যাচ্ছে, অই। .... তারপর অন্ধকারে, তীব্র অন্ধকারে, নিজের মুখ আড়াল করে, স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে, সে, ঢুকে গেল দুর্বোধ্যতর আরও এক নারীর স্বপ্নে। ....
নারী কী, আমি জানি না। এই যে আমি নারীকে লিখতে পারছি না, আমি বুঝি, শুধু একটি অপঠিত নারীর ঈপ্সিত অলঙ্কার ও তার নিরবচ্ছিন্ন অন্বেষা কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, নিস্ফল শূন্য বিহার-সম, আমাকে ক্রমশ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শায়িত, দীর্ঘ বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে এক নারীর দিকে।
আমি যে লিখতে পারছি না, এ আমার অভিজ্ঞতার হাহাকার। নারী বিষয়ে কোনো প্রিফিগারই তৈরি হয়নি আমার মনের স্লেটে। এই মুহূর্তে আমার ধারেকাছে কেউ নেই, যে আমার সহায়। কে এই শায়িত রমণী? কী তার পরিচয়? যে নারী আমার অন্বিষ্ঠ, যে আমার সোনার পাথরবাটি, সেই কি এ?
আমি যে লিখতে পারছি না, আমি জানি, এ আমার যৌন অতৃপ্তির প্রতিদান। এক নিরন্তর পাপ ও তার জিন আমাকে অতৃপ্ত রেখেছে। ঐ জিনই আমাকে লিখতে দিচ্ছে না। আমি লিখতে তখুনি পারবো যখন এই শায়িত ধূসরিত বহুধর্ষিত নারীটিকে আমি সমগ্রভাবে এবং ভরপুর পাবো। শুধুমাত্র অভিজ্ঞান দিয়ে নারীকে গর্ভবতী করা সহজ কিংবা সমাজ-অনুমোদিত উপন্যাস। অথচ যে-সৃষ্টি আমি দিতে চাইছি, যে নির্মাণ, তাতে স্রষ্টাকে সর্বাগ্রে হতে হয় হারমাফ্রডাইট, পক্ষান্তরে উভলিঙ্গ।
আমি নিজেকে নিজের প্রেক্ষিতে এবং তোমাকে তোমার অধিধ্যানে সুসম্পূর্ণ জেনে নিতে চাই মৃণা! তুমিই কি সেই, যা আমার অন্তরাত্মার বহির্বাস?
মৃণা, তুমি আমাকে মাদারলি আদর করো। এই আমি চোখ বুজলাম।